রবিবার, ১৫ জুলাই, ২০১২

তুমি আছো

তুমি আছো
তাই বেঁচে আছে আমার প্রাণ
আমার ছিন্নবাধা পলাতক মন,

তুমি আছো
তাই আজও আমার শিরা উপশিরাগুলো শিহরিত হয়,
অনুভূতি জাগায়
রক্তে ভালোবাসার ভাইরাস প্রবাহিত হয়।

তুমি আছো
তাই আজও আমি স্বপ্ন দেখি কয়েকটি সোনালী দিনের,
ফুলে শোভিতো একটি বাসর শয্যার।

তুমি আছো
তাই আজও আমি দুর্বা ঘাসের টলমলে শিশিরের স্নিগ্ধতা অনুভব করি,
অনুভব করি তোমার লজ্জারাঙ্গা মুখ
ভাসা ভাসা দুটি চোখ,
উদাসী জানালার পাশে বাতাশে উড়া তোমার একগুচ্ছ কেশ
আর তোমার উষ্ণ পরশ।

তুমি আছো বলেইতো
আজও আমার কলম চলে
গল্প কবিতা আর উপন্যাসের খাতায়।

প্রতিক্ষা

হারিয়ে গিয়েছো তুমি
কিন্তু হারিয়ে যায়নি তোমার স্মৃতির পান্ডুলিপি
আমার হৃদয় থেকে।
তাইতো এই মন আজও তোমাকে খোঁজে
কখনো পাখিদের মেলায়
কখনো জোনাকিদের আলো আধারের মাঝে।
চাঁদের আলো দিয়ে খুজেছি তোমায়
কখনো গ্রহ নক্ষত্র
আবার তারাদের ভীড়ে।
খুঁজে পাইনি
তবুও হতাশায় নুয়ে পড়েনি আমার জীর্ণ শরীর,
খুঁজেছি তোমায় নদীর পাড়ে গ্রামে গ্রামে
কখনো সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মাঝে।
খুঁজে পাইনি তোমায়,
আজ আমি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত।

মাঝে মাঝে মনে হয়
তুমি আছো
এই পৃথিবীর অদৃশ্যের মাঝে
না হয় মিশে গিয়েছো এই বাংলার সরশ মাটির বুকে
তবুও তোমার প্রতিক্ষায় থাকবো
আমার হৃদয় জানালা খুলে।

তোমাকে ভাবি

যখন পাখিদের কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভাঙে না,
যখন নিকোশ কালো অন্ধকারের ঘোর কাটে না,
যখন সূর্য্য তার পূর্ণ শক্তি দিয়ে ভূপৃষ্ঠে আলো ছড়ায় না,
তখন আমি একান্ত নিজের করে তোমাকে ভাবি।

যখন মানুষ জীবিকার সন্ধানে বাহির পানে ছোটে,
যখন অজানা গন্তব্যের সন্ধানে আমি ছুটে বেড়াই দিক হতে দিগন্তে,
তখন একান্ত নিজের করে আমি তোমাকে ভাবি।

যখন মানুষ সারাদিনের কর্মক্লান্তি শেষে ফেরে আপনজনের কাছে,
যখন পাখি উড়ন্ত দুর্বল ডানা নিয়ে ফেরে আপন নীড়ে
যখন দিগভ্রান্তের মত নিরাশায় আমার জীর্ন কুটিরে চরন রাখি,
তখন একান্ত নিজের করে তোমাকে ভাবি।

যখন মানুষ পরিশ্রান্ত অলস দেহটাকে এড়িয়ে দেয় প্রেমার্ত মাটির বুকে,
যখন ঝিঝি পোকা বোবা প্রকৃতিকে শোনায় ঝিঝি শব্দ
যখন জোনাকীরা মৃদ মন্দা আলো ছড়িয়ে খেলা করে
যখন চন্দ্র তার লজ্জা রাঙা মুখখানি মেঘের আড়ালে ঢাকতে চায়
তখন আমার চোখ দুটি তন্দ্রায় ঢলতে থাকে,
তখন আমি বালিশের উপর মাথা রেখে
একান্ত নিজের করে তোমাকে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি।

আমার বাবা এবং একটি ঘটনা

সেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে যখন এই পৃথিবীর পথে যাত্রা শুরু করেছি, সেই থেকে বাবার হাত ধরেই শুরু। এখনো এই অগ্রযাত্রার পথ প্রদর্শক আমার বাবা। জীবনের প্রতিটি সাফল্যে যেমন বাবার অনুপ্রেরণা পেয়েছি আবার ব্যর্থতায় তাকে পাশে পেয়েছি সমানে সমান। তিরস্কারমূলক কোনো বাক্য কখনো বলেছে কি না আমার মনে পড়ে না।
মনে পড়ে, সেই ছোটবেলায় বাবা সারা দিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতেন। তখন তাকে একটু অবসরের সুযোগ না দিয়ে কাঁধে চড়ার বায়না ধরেছি। হাজারো অবান্তর প্রশ্নবানে বিরক্ত করেছি। কিন্তু বাবা কখনো বিরক্ত না হয়ে বরং আদরের পরশ বুলিয়ে দিয়েছেন আমার তুলতুলে গালে।
যদি কখনো অসুস্থ হয়েছি, মনে হয়েছে বাবার সমস্ত সুখের ঘরে যেন আগুন লেগেছে। কখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন, নিয়ম করে ওষুধ খাইয়ে সুস্থ করে তুলবেন, শত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতেন সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। যদি কখনো বড় ধরনের অসুস্থ হয়েছি তাহলে পাশে থেকে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিয়েছেন বাবা। আর আরোগ্য লাভের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে করেছেন প্রার্থনা।
যখন পরীক্ষা ঘনিয়ে আসত তখন আমার চেয়ে বাবার মুখে চিন্তার ছাপ বেশি পড়ত। আমার শরীরটা ঠিক আছে কি না, পড়াশোনার চাপটা আমার ওপর বেশি পড়ছে কি না, কাঙ্খিত ফলাফল করতে পারব কি না—এ রকম শত উদ্বিগ্নতা ছেয়ে ধরত বাবার।
যদি কখনো বাড়ি ফিরতে বেশি রাত হয়েছে তাহলে এক মুহূর্ত ঘরে না থেকে আমার আড্ডার সমস্ত স্থান তন্ন তন্ন করে খুঁজে ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন আমাকে। চিন্তা একটাই কোনো বিপদে পরলাম কি না। মাঝে মাঝে আমাকে ঘিরে বাবার এমন কাণ্ড দেখে মনে হতো আমিই বুঝি বাবার সমস্ত সুখের একটা পৃথিবী।
এ রকম হাজারো স্মৃতি আজ তাড়া করে ফেরে আমাকে।
২০০২ সাল। আমরা তখন রাজবাড়ীতে থাকি। বর্ষাকাল চলছে। একদিন মুষলধারে বৃষ্টিঝরা এক রাতে মা বারান্দায় বেরিয়ে দেখতে পান বিরাট বড় একটা গোখরা সাপ আমাদের বাড়ির উঠান থেকে আমার শোয়ার ঘরের দিকে উঠে আসছে। মা তখন সাপটিকে একটি লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে দেন। আমাদের বাড়ির আশেপাশে এমন ভয়ংকর একটা সাপের অস্তিত্ব পরিবারের সবাইকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দেয়। এই ঘটনার কিছুদিন পর এক মধ্য রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আমার হাতের একটি আঙুলে ব্যথা অনুভব করলাম। ঘুম থেকে উঠে লাইট জালিয়ে দেখি আমার হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাবা-মাকে দ্রুত ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম। বাবা-মা আমার কাছে এসে হাত দিয়ে রক্ত ঝরা দেখে আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে আশপাশের ঘুমন্ত মানুষদের জাগিয়ে তুলে সারা বাড়ি ভরিয়ে ফেললেন। বাবা-মায়ের ধারণা ওই সাপটাই আমাকে দংশন করেছে। মা তাৎক্ষণিক আমার হাতে দড়ি দিয়ে বেধে দিয়েছিলেন যাতে বিষ দ্রুত আমার শরীরে ছড়িয়ে না পড়ে। বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠা দেখে আমিও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যে এই সুন্দর পৃথিবীকে ইতি জানাতে হবে আমাকে। আর বাবা-মায়ের চোখেমুখে দেখছিলাম সন্তান হারানোর এক অগ্রিম শোকাবহ বেদনা।
ওই সময়টাতে বাবা ছিলেন প্রচণ্ড রকমের অসুস্থ। বিছানা থেকে ঠিকমতো উঠতে ও হাঁটতে পারতেন না। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে অনেক দিন ধরে ঘরে পড়ে আছেন। এ অবস্থায় বাবাকে বাড়িতে রেখে, প্রতিবেশী লোকজন দ্রুত রিকশায় করে আমাকে আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে বিন্দুপাড়ায় এক ওঝার বাড়িতে নিয়ে যায়। ওঝা যখন আমাকে ঝাড়ফুঁক দিচ্ছিল তখন আমার কানে ভেসে আসছিল এক আর্ত চিৎকার। বেহালার করুণ সুরের মতো ভেসে আসছিল কিছু বাক্য—খোদা এত বড় শাস্তি কেন দিলে আমাকে, কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত তুমি আমাকে দিয়ে করাতে যাচ্ছ। কণ্ঠটি আমার চিরচেনা ও অতি আপন মনে হচ্ছিল। ওঝার ঝাড়ফুঁক ও কবিরাজি দাওয়াই শেষ করে রাস্তায় এসে দেখি তিনি আর কেউ নন—আমারই বাবা। আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। যে মানুষটি অসুস্থতার জন্য দাঁড়াতেই পারছিলেন না, তিনি তিন কিলোমিটার পথ রিকশার পিছে পিছে দৌড়ে কীভাবে এলেন। সেদিন আমার প্রাণপ্রদীপ নিভে যায়নি। উদ্‌ঘাটনও হয়নি সেদিন সাপের কামড়ে আমার হাত দিয়ে রক্ত ঝরেছিল নাকি অন্য কিছু। যাই হোক না কেন, সেদিন আমার বাবার চোখে মুখে যে আকুতি দেখেছি, সন্তান হারানোর যে অগ্রিম হাহাকার দেখেছি, তা আমি কখনো ভুলতে পারি না।

আজ বাবাকে ছেড়ে সুদূর ফ্রান্সের প্যারিস শহরে আমার বসবাস। তবুও প্রতিটি মুহূর্তে বাবার ছায়া আমাকে আচ্ছাদিত করে রাখে।
যদি কখনো কাজের ব্যস্ততায় ফোন করতে বিলম্ব হয় বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তোর কোনো অসুবিধা হয়নি তো বাবা, সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো। বাবা এখন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে অবসর জীবনযাপন করছেন। তবুও কখনো মুখ ফুটে বলেন না, আমার জন্য টাকা পাঠাস বাবা। সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই তার প্রার্থনা আমার প্রাণবায়ুটা যেন সব সময় সচল থাকে।
বাবার এই অকৃত্রিম অগাধ ভালোবাসার কিঞ্চিৎ​ প্রতিদানও দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রতীক্ষা শুধু, আবার কবে বাবার কাছে ফিরে যাব, বাবার কোমল বুকে আমার বুক রেখে জড়িয়ে ধরব।
বাবা, শত সুখের মাঝেও তোমার ওই আদর মাখা হাতের স্পর্শের খুব অভাব অনুভব করি।

প্রতিশোধ নেবো

আমি প্রতিশোধ নেবো
আমি ঝাঁপিয়ে পড়বো তোমাদের উপর ঝড় হয়ে,
আমি জলোচ্ছ্বাস হয়ে ভাসিয়ে নেবো তোমাদের বংশধর।

আমি প্রতিশোধ নেবো
যারা আমার নামের পাশে সেঁটে দিয়েছো দুর্নীতি গ্রস্তের তকমা।
আমি অগ্নুৎপাতের ন্যায় পুরিয়ে নিঃশেষ করে দেবো
তোমাদের মূল শিকড়।
যারা আমার সোনার ছেলেদের হাতে কলমের পরিবর্তে তুলে দিচ্ছো মারণাস্ত্র,
মুখে তুলে দিচ্ছো কালো লাল নীল হলুদ মরণ পানি আর নরক ধোঁয়া,
আমি অশ্বারোহীর ন্যায় ঝাপিয়ে পড়বো তোমাদের বুকের উপর,
চূর্ন বিচূর্ণ করে দেবো তোমাদের পাঁজর
পাল্টে দেবো মুখাবয়ব
বধির করে দেবো চিরতরে
যারা আমার জন্মকে কলঙ্কিত করছো
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পরিচয় করে দিচ্ছো জারজ সন্তান হিসেবে!

তোমরাই বল
আমি কি জারজ সন্তান?
আমার কি জন্ম পরিচয় নেই?

আমিও তো বিশ্বের চিরাচরিত নিয়মে
অন্য দশ জনের মতই
আমার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রঞ্জিত করেছি রক্তের লাল রঙে,
বিশ্ব বিধাতার কাছে সমর্পণ করেছি
ত্রিশ লক্ষ সন্তান,
তোমাদের মধ্য থেকেই তো সেদিন তৈরি করেছিলাম
একজন সূর্য সন্তান
যে তোমাদেরকে আলোর নির্দেশনা দিয়েছিলো।

অনন্ত ভাবনা

বিনিদ্র রাত্রি জাগরন
সেতো শুধু তোমারই ভাবনায়,
হৃদয় আকাশের কোথা হতে তুমি উল্কার মত উদয় হয়ে
আবার মিশে য়াও মহাকাশে,
শুধু বাড়িয়ে দাও ভাবনা।

তোমাকে ভাবতে ভাবতে
আমি ভাবনার মহাকাশে মিশে যাই
তবুও ভাবনার কুল খুজে পাইনা।

কোন এক পড়ন্ত বিকেলে নদীর পাড়ে কবি মনা ভাবে বসে দু লাইন কবিতা
সেতো শুধু তোমারই ভাবনায় লেখা।
অনুরাগে কবিতার কাগজটুকু নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিলাম পদ্মার ঘোলা জলে,
ভেবেছিলাম ভাবনার শেষ এখানেই হবে,
শেষ হয়নি
বরং তোমাকে ভেবে লিখেছি এক গুচ্ছ বিচ্ছেদ প্রেমের কবিতা।

শুরু আছে যার,শেষও আছে তার
এই পৃথিবীও একদিন শেষ হবে,
জানিনা তোমাকে নিয়ে আমার ভাবনার শেষ হবে কিনা।

Eternal Thought

All my Sleepless nights
Passes only thinking of you
like a meteorite you emerge in the sky of my mind all on a sudden
then disappear into the space soon,
just leaving me alone with the mounting thought .
Thinking of you
I often get lost into the vast space
Still don’t find the edge of this notion
On an afternoon, sitting of beside the bank of river
my poetic heart wrote some verses of love
it’s for none but in thought of you
then being gloomy I make some paper boat with it
and drift it in the messy water of Padma,
Thinking it would be the end of it.
But being all in vain
I ended up with a bunch of severance poems.
Things that have a beginning have an ending too 
One day the world will end,
I don’t know whether it will be the end of my eternal thoughts for you.

Translator: Ayesha Siddiquea

তুমি

তুমি আমার জীবনের
একগুচ্ছ কবিতা,
একটা দীর্ঘ উপন্যাস,
খন্ড খন্ড ছোট গল্প
আর তোমাকে পাওয়ার
মিথ্যে প্রতীক্ষা ।

কবিতা লিখতে পারিনা

এখনো বর্ষার নদী পূর্ন যৌবনে ভরে উঠে,
প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে নদীর ধারে ফুটে কাঁশ ফুল,
এখনো নদীর পারে পড়ন্ত বিকেলে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবগাহন করি,
কিন্তু, কোন কবিতা লিখতে পারিনা।

এখনো কদম ফুলের গন্ধ মাতাল করে দেয় আমাকে
সন্ধ্যা নামলে বাগান থেকে ভেসে আসে হাসনাহেনা গন্ধরাজের গন্ধ,
এখনো পূর্নিমার রাতে চন্দ্র জোস্না ছড়ায়,
মেঘলা আকাশে গুরি গুরি বৃষ্টি ঝড়ে
শুনতে পাই মূশলধারে বৃষ্টি ঝড়ার রিমঝিম শব্দ,
কিন্ত, কোন কবিতা লিখতে পারিনা।

এখনো বসন্তের মধান্হে শুনতে পাই ককিলের কুহু কুহু ডাক
ঝিঝি পোকার ঝি ঝি শব্দ,
এখনো চৈত্রের দুপুরে উত্তপ্ত বাতাস খোলা মাঠে ঘুর্নিপাক খেলে,
আমি শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি
কিন্তু, কোন কবিতা লিখতে পারিনা।

কারন
তুমি নেই বলে।

I can’t write a Poem

Still the river of rainy day becomes full of youth
Following the rule of nature,
Flowers appear along the river;
In the declining afternoon sitting beside the river,
I still drench with the beauty of nature;
But, I can’t write a Poem.
Still that mind ripping fragrance of Kadam makes me crazy,
Still air carries the smell of night flowers to me;
Still the moon spreads it light in the full moon
Sometime I hear the drizzling sound of the cloudy sky,
Sometime the rhythmic sound of torrents;
But, I can’t write a Poem.
Still in the midday of spring I hear the cuckoo’s cooing
Also hear the restless crickets;
Still in the summer evening the hot air arouses storm,
I remain staring at the sight speechless;
But, I can’t write a Poem.
Because ……..You are not with me.

Poet: Muhammad Golam Morshed
Translate: Ayesha Siddiquea

তোমাকে পাওয়ার পর থেকে..

এখন আমার কোন কিছুই ভালোলাগে না
কেমন যেন উদাসী হয়ে গিয়েছি আমি
পাঠ্য বই!
সে তো সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছি,
ধর্ম কর্মও প্রায় শেষ হবার উপক্রম।
কয়েকটি উপন্যাস,কিছু সাহিত্য পত্রিকা,আর ছোট্ট একটি ক্যাসেট প্লেয়ার
ওরা আমার প্রকৃত বন্ধু
ওদেরকে ঘিরেই কেটে যায় আমার অফুরন্ত সময়ের ভান্ডার।

'মেম সাহেব' উপন্যাসের মেম সাহেবের করুন পরিণতি,
'আজও চমৎকার' উপন্যাসের দিপার দুঃখ ভরা দিন,
'সুখের কাছে' উপন্যাসের সুখনকে ছেড়ে মহুয়ার বিদায় বেদনা,
আমাকেও ব্যথিত করে তোলে।

প্রেম করে এখনো ব্যর্থতার সেই করুন সুর কানে আসেনি,
তবুও অশ্রু ভেজানো গানগুলো ভালোলাগে,
ওরা আমার হৃদয়ের সাথে মিশে যায়,

সাহিত্য পত্রিকা খুললে,
ভালোলাগে না কোন স্বনামধন্য লেখকের প্রবন্ধ,
কোন জীবনবাদী কবিতা।
অখ্যাত লেখকের লেখা গল্পে যদি থাকে রোমাঞ্চিত প্রেম কাহিনী,
কিংবা রসালো প্রেমের কবিতা
তাহলে সবটুকু পড়ে ফেলি,
ভালোলাগা লাইনগুলো মাঝে মাঝে নোট করে রেখে দেই।

তোমাকে পাওয়ার পর থেকে
সংবাদপত্র অফিসে বসে গল্প করে সময় কাটানো আর ভালোলাগেনা,
ভালোলাগেনা
সভাসমিতী,প্রেস কনফারেন্স,গণগ্রন্থাগার।

কতদিন ধরে কলেজের মুক্ত ক্যাম্পাসে আমার পদচারনা নেই,
আর থাকবেই বা কেন?
কলেজের সেই আনন্দঘন মূহুর্তগুলো কবেই স্মৃতির এ্যালবামে বন্দী হয়ে গিয়েছে,
তবুও মাঝে মাঝে স্মৃতিগুলো মনে দোলা দেয়,
কলেজের একাডেমিক ভবনের ছাঁদে উঠে
লুকিয়ে বন্ধুদের প্রেম পত্র পড়া,
অনন্যা বিথীদের বাদাম চক্রের আড্ডায় আমার দুষ্টমী,
এগুলো এখন শুধুই স্মৃতি।

এখন আমার জীবনে শুধু
তুমি তুমি আর শুধুই তুমি।

After I Get You

I don’t feel good in anything now
I have become somewhat absent minded.
Text book!
I left it many days ago,
Religious activities are about to up.
Some novels, literary magazines, and a small cassette player
Have become my close friends,
All my valuable time passes surrounding them.
The tragedy of the Mem in the “Mem Shaheb” novel afflicts me
So as the sorrow-full days of Dipa in the “Aaj o Chomotkar”
or Mahuya’s painful farewell to Shukhan, in “Shukher Kachee”.
yet I haven’t heard the tune of failure in love,
But still the sad melodious song touches me and merges with my heart.
In the literature page,
The article of any renowned author or any obscure poem doesn’t attract me.
Some thrilling love stories of some unknown writer
Or some luscious love poems,
Only makes me read them fully.
After getting you
I don’t like wasting time with idle talk in the office,
Not even mass meeting, press conferences or public library.
It’s have been long time no see the campus,
But what’s the need of it?
The joyful moments of campus already made their room in the album of memory,
Though, I think of them over and over again.
Reading the secret love letters of friends sitting on the roof of academic building,
Or naughty moments passed in Ananya and Bithi’s hang out party are just distant past.
Now in my life I have none but you, only you.


Poet: Muhammad Golam Morshed
Translate: Ayesha Siddiquea

ভালোবাসার বৃষ্টি-১

প্রাইভেট ব্যাচেই বৃষ্টির সাথে প্রথম দেখা।একই মফস্বল শহরে বাস করলেও পূর্বে কখন আকাশের সাথে বৃষ্টির চেনাজানা এমনকি চোখের দেখা পর্যন্ত হয়নি। বৃষ্টিকে প্রথম দেখাতেই আকাশের মধ্যে এক অজানা তোরপার শুরু হয়।স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে আকাশ বৃষ্টির স্নিগ্ধ কোমল মুখখানির দিকে আবেগ আপ্লুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বারবার। আকাশ মনে মনে ভাবে,বৃষ্টির কাজল কালো ডাগর চোখ দুটি যেন আমাকে ভালোবাসার কথা বলছে।অতীতে কোন মেয়েকে দেখে এমনটি হয়নি কখনও আকাশের।এভাবেই একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায় একটি ঘন্টা। হঠাৎ পড়া শেষ করে স্যার সবাইকে চলে যেতে বলে।প্রাইভেট পড়ার রুম থেকে বেরিয়ে প্রচন্ড় ভাবাবেগের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খুজতে খুজতে বাসায় ফেরে আকাশ।

প্রতিদিনের মত আজ রাতেও পড়ার টেবিলে বসেছে আকাশ।অন্যান্য দিন পড়ার টেবিলে বসলে হোম ওয়ার্ক শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু আজ কিছুতেই পড়ায় মন বসছেনা আকাশের।বৃষ্টির মায়াবী মুখ,কাজল কালো ডাগর দুটি চোখ,চন্চলা হরিনীর মত স্বভাব সব সময় যেন আকাশের চোখের তারায় ভাসছে।ভাবছে এখন যদি বৃষ্টিকে কাছে পেতাম তাহলে হৃদয়ের গহব্বরে সন্চিত কথাগুলো ওকে ব্যক্ত করতাম।বইয়ের পাতাগুলো এলোমেলোভাবে উল্টাচ্ছে।পড়াশুনা যেন আজকে ভুলেই গিয়েছে আকাশ।এভাবেই রাত গভীর হয়ে গেলো, চোখের পাতায় ঘুম ধরছেনা কিছুইতেই।আকাশের আবেগ উচ্ছাসিত হৃদয় শুধু বৃষ্টির কথাই বলছে।ভাবছে আজ আমার কেন এমন হলো,আগেতো কখন এমনটি হয়নি আমার, আমি কি বৃষ্টিকে ভালোবেসে ফেলেছি? কতনা প্রশ্ন হৃদয়ের মনিকোঠায় জমাট বেধেছে,সে প্রশ্নের উত্তর খুজে পাচ্ছেনা আকাশ।হঠাৎ খাতা থেকে একটুকরো কাগজ ছিড়ে বৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখা শুরু করে।কবিতাটা শেষ করে দেয়াল ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত তিনটা বেজে গিয়েছে।এভাবে রাত জাগলে সকালে রনজয় স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া হবেনা এই ভেবে ঘুমিয়ে পড়ে আকাশ।এরপর বাকি রাতটুকু কোন মধুর স্বপ্নে কাটিয়ছে তা শুধু আকাশই জানে।

মেঘলা আকাশ গুরি গুরি বৃষ্টি পড়ছে ,দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল এমনি একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরছে আকাশ পথিমধ্যে বৃষ্টির সাথে দেখা। আকাশ মনে মনে ভাবছে,বৃষ্টিকে ডেকে কি বলবো আমার জমানো অব্যক্ত কথাগুলো কিন্ত দুরু দুরু বুক কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না।হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু গেলো,রাস্তার পাশে একটি বাড়ীর বেলকুনিতে আশ্রয় নেয় বৃষ্টি।অন্য উপায়ন্ত না পেয়ে আকাশও আশ্রয় নেয় ঐ বেলকুনিতেই।রাস্তায় লোকজনের খুব একটা চলাচল নেই।নির্জন নিস্তব্ধ বেলকুনিতে শুধু আকাশ আর বৃষ্টি।বেলকুনির দুই প্রান্তে নির্বাক দাড়িয়ে আছে দুজন।অজস্র কথামালা ঢেউ খেলছে দুজনের মনে।মাঝে মাঝে লজ্জামিশ্রিত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে দুজন।কিন্ত কেউ কাউকে কিছু বলতে পারছে না,মনে হচ্ছে বিরাট একটা পাথরের দেয়াল তাদেরকে আলাদা করে রেখেছে।

এভাবেই প্রায় দেরটি ঘন্টা একই বেলকুনিতে কেটে যায় দুজনের।মেঘের বর্ষন শেষ।বৃষ্টি বেলকুনি থেকে নেমে হাটতে থাকে রাস্তায়।আকাশ ভাবে এতটা সময় দুজন এক সাথে পাড় করলাম কিছুই বলতে পারলাম না! তবুও মন মানছেনা কিছুতেই।আকাশ বৃষ্টির পিছু নিয়ে বৃষ্টির কাছে গিয়ে বলে,বৃষ্টি শোন.....বৃষ্টি যেন কোন কিছু না শোনার ভান করে হাটতে থাকে।হঠাৎ বৃষ্টির গতি রোধ করে সামনে দাড়ায় আকাশ এবং বলে আমার মনের মধ্যে জমানো সঞ্চিত কথাগুলো যদি না শোন তাহলে হয়ত শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাবে আমার,আমি এভাবে আর বয়ে বেড়াতে পারছিনা,এই সুন্দর পৃথিবীতে সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমার জীবনে তোমাকে একান্তই দরকার, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি বৃষ্টি,এখান থেকে ফেরা আর সম্ভব নয়।
আকাশের মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর বৃষ্টির সমস্ত মুখ মন্ডল রক্ত বর্ণ ধারন করে,চোখের পাতাগুলো কাঁপতে থাকে,পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা যেন ভর করে বৃষ্টির সমস্ত অস্তিত্বে...........................

শনিবার, ১৪ জুলাই, ২০১২

একটি চিঠি এবং ভ্রমন বৃত্তান্ত

প্রিয় শ্রাবন্তী,
শুভেচ্ছা নিয়ো।আশা করি ভালো আছো।তোমাকে ছাড়াই সমুদ্র পরিভ্রমণ শেষ করে ঢাকায় ফিরে এসেছি।তুমি আমার সঙ্গে না থাকলেও ভ্রমনের প্রতিটিক্ষণ আমার অনুভূতিতে সঙ্গী হয়ে ছিলে ছায়ার মত।ভ্রমণ বৃত্তান্তের সঙ্গে  তোমার জন্য হৃদয়ের কোণে ক্ষণে ক্ষণে জাগা অনুভূতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরলাম  ...... 

আমাদের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে দীর্ঘদিন যাবদ  কক্সবাজার ভ্রমনের একটা পরিকল্পনা চলছিলো পরে সেটা যখন বাস্তবে রুপান্তরিত হলো তখন শিক্ষকেরা আমাদেরকে এই সফরে অংশগ্রহনের জন্য তাড়া দিচ্ছিলো। 


মনে হচ্ছিলো,এমন একটি সমুদ্র ভ্রমনে যদি একান্ত প্রিয় কোন বন্ধু কিংবা প্রিয় মানুষ পাশে না থাকে তাহলে নিষ্প্রাণ এরকম ভ্রমনে গিয়ে অনর্থক সময় নষ্ট করার কি দরকার।  তাছাড়া তোমার দীর্ঘ দিনের ইচ্ছা কক্সবাজার ভ্রমন করা , তাই তুমিহীনা  ইচ্ছে ছিলোনা এই ভ্রমনে যোগ দেবারইচ্ছে ছিলো, কক্সবাজার গেলে তোমাকে সঙ্গে নিয়েই যাবো।।সেজন্য রাজবাড়ী কলেজ থেকে অনেকবার কক্সবাজার ভ্রমনের উদ্যেগ নিয়েছি কিন্ত সফল হইনিতাই এই ভ্রমন নিয়ে আমার তেমন কোন বিশেষ ইচ্ছে বা আগ্রহ মনের মধ্যে তাড়া করছিলো না।আবার যখন ভাবলামতুমি নাইবা হলে আমার ভ্রমন সঙ্গী কিন্তু আমার মোবাইল ফোনতো আছে। সৈকতে পাশাপাশী বসে নাইবা পারলাম আমার উচ্ছাস তোমাকে ব্যক্ত করতে, কিন্তু উচ্ছাস ব্যক্ত করার মাধ্যমতো একটা আছে। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে যাওয়ার জন্য মন স্থির করলাম।কিন্তু সমস্যা হয়ে দাড়ালো অর্থনৈতিক সংকট, যাইহোক এই সমস্যারও একটা ব্যবস্থা হয়েগেলো।পরে ভ্রমনের নির্ধারিত চাঁদা জমা দিয়ে ভ্রমন নিশ্চিৎ করলাম আর তোমার জন্য মোবাইল কার্ড বাবদ বাজেট নির্ধারিত হলো তিন শত টাকা।

এর পর থেকে প্রহর গুনছিলাম কাঙ্খিত ২১ফেব্রুয়ারী তারিখের প্রতিক্ষায়।অবশেষে এলো ২১ তারিখ আর আমাদের যাত্রা শুরুর সময় নির্ধারিত হলো রাত ৯টা ৩০ মিনিট।
যখন সবকিছু গোচগাছ করে ৮টা ৩০ মিনিটে বাসা থেকে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হই, তখন পথের মধ্যে ঢাকায় আসার পর এই প্রথম বোবা প্রকৃতি আমাকে দারুনভাবে মুগ্ধ করছিলো।দীর্ঘ দিন মেকি শহরের মেকি সভ্যতার মধ্যে বসবাস করতে করতে আমার আমিত্বটাকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।তুমিতো জানো বসন্ত আমার প্রিয় ঋতু।বসন্তের প্রকৃতিতে আমি নতুন এক মানুষে রুপান্তরিত হই,যখন একান্ত নিজের করে বসন্তের প্রকৃতিকে অবগাহন করি তখন আমার মধ্যে এক নিষ্পাপতা অনুভব করি,আমার অনুভূতিতে পৃথিবীটাকে অনেক সুন্দর মনে হয়,পৃথিবীর সমস্ত প্রেম ভালোবাসা ভর করে আমার মধ্যে।ক্যালেন্ডারের পাতাটা উল্টিয়ে বুঝেছি এখন প্রকৃতিতে বসন্ত চলছে।কিন্তু বসন্তের কোন রং রুপ গন্ধ এবার আমার মনের বীনায় সুর তোলেনি।কারণ, বসন্তের প্রকৃতির কিছু নিজস্বতা রয়েছে,যেমন কোকিলের ডাক,আম্র মুকুলের গন্ধ,খোলা প্রান্তরে মৃদমন্দ বাতাস,কাননে কাননে ফোটা ফুল,মৌমাছির গুঞ্জন,বৃক্ষে বৃক্ষে কচি পাতা আর আমার বর্ণনার বাইরে অনেক কিছু।যেখানে অবাধ বিচরনের জায়গা নেই সেখানে ককিলের ডাক শোনা যাবে কোথা থেকে।ঢাকার বাতাসে ভেসে আসে প্রেট্রোলের গন্ধ,কৃত্রিম কাননের টবে ফুল ফুটলেও মৌমাছির গুঞ্জন শোনা যায়নাঢাকার বৃক্ষরাজী নব পল্লবে ভরে উঠলেও ওদের রুপের দিকে তাকানোর একটু সময় এই ব্যস্ত নগরীর মানুষের নেই,তাই ওরা উজার করে ওদের সৌন্দর্য্য প্রকাশ করেনা।এই ঢাকাতে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করার মত দুই একজন পাগল রাস্তা ঘাটে ঘোরাঘুরি করলেও ওরাও বুঝতে পারেনা কোন ঋতুতে অবস্থান করছে।আমার অবস্থা ঠিক এমনই।ভেবেছিলাম বসন্ত উপভোগ করতে দু চার দিনের জন্য গ্রামের বাড়ীতে যাবো,অনেক রাত অবধি বসে থাকবো আমার সেই ছেলে বেলার ন্যাংটো হয়ে ঘোলা জলে ডুব সাঁতার পারা নদীর ধারে,হেরে গলায় গলা ছেড়ে গান গাইবো 'আহা আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোঁটে কত পাখি গায়'যদিও আমার সেই নদীর বুকে এখন কোনো পানি নেই,তবুও ওর রুপে একটা মাদকতা আছে,তাই ওর সান্নিদ্ধের নেশা জাগে।পাইচারি করবো আমার সোনালী কৈশরের ভর দুপুরে নাটাই ঘুড়ি হাতে দৌড় পারা সবুজ মাঠে।কিন্তু হলোনা,হয়তোবা আর হবে না।যাইহোক অপ্রাসঙ্গীক বিষয়ে চলে যাচ্ছি........

যখন আমি কলেজ গেটে পৌঁছুই তখন ভ্রমন বাস কলেজে পৌঁছায়নি।আমার ভ্রমন সঙ্গীদের প্রায় সবাই বাসের অপেক্ষায় বসে আছে।কিছুক্ষণ পর, অর্থাৎ ৯টা৩০ মিনিটে ক্যাম্পাসে ভ্রমন বাসটি আসার সঙ্গে সঙ্গে  ভ্রমন সঙ্গীরা চর দখলের মত হুরমুর করে বাসে উঠে ছিট দখল করলেও নির্ধারিত সময়ে আর বাস ছাড়লো না।কিছু কিছু বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের শুরু হলো বাকবিতন্ডা,হতে লাগলো সময় ক্ষেপন।এই বিদঘুটে পরিবেশ থেকে নিজেকে কিছুটা আড়াল করে নিলাম। হঠাৎ নিজের মধ্যে এক ভালোলাগা শুরু হলো,এক আচমকা ভালোলাগা। মনে হচ্ছিলো তিতুমীর কলেজের সবুজ মাঠ এক নতুন সাজে সেজে উঠেছে,মৃদমন্দা ফুরফুরে বাতাসে দোল খাচ্ছিলো কলেজের বোবা বৃক্ষগুলোর শাখা প্রশাখা।আকাশে চাঁদ ছিলো,আর মনে হচ্ছিলো চাঁদের মিষ্টি আলো স্ফুলিঙ্গের মত ছিটকে পড়ছিলো পৃথিবীতে।আমি ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছিলাম পৃথিবীর সমস্ত কোলাহলের জাল ছিড়ে অন্য জগতে,মনের অজান্তেই ভেতর থেকে একটা গানের লাইন বেরিয়ে আসছিলো 'বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা,দূর নীলিমায় ঠে চাঁদ বাঁকা,শুধু এই পথো চেয়ে থাকা ভালো কি লাগে'আর তোমার শূন্যতায় ভরে উঠছিলো বুক।
মনে পড়ছিলো তোমার অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোর কথা।তোমার ইচ্ছে করে জোস্না রাতে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে,ঝিল অথবা বিলে ডিঙ্গা ভাসিয়ে ঘুরতে,অবারিত লীলাকাম সবুজ বনানীর মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে।এগুলো শুধু তোমার ইচ্ছে হয়ে রয়েছে কিন্তু তুমি পারছনা প্রকৃতির এই বাস্তবতার পথ দিয়ে হাঁটতে।মনে হচ্ছিলো তুমি বন্দি,তুমি লোহার খাঁচায় বন্দি।আমার ইচ্ছে হয়,তোমাকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করে ছেড়ে দেই প্রকৃতির স্বর্গ ভূমিতে,তুমি পান করো প্রকৃতির অমেয় সুধা,স্নান করো ঝর্ণার স্বচ্ছ ফটিক জলে।
হঠাৎ শুনলাম বাস ছেড়ে দেবে,সবাইকে বাসে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।আমি ছিটকে পড়লাম আমার ভাবনার জগত থেকে,আর বুঝতে পারলাম আমি বসন্তে ছিলাম।
মনটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠলো।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ১২টা১৫ বাজে।অনেকটা ভয়ে ভয়ে তোমাকে ফোন দিলাম কিন্তু ফোনের ওপারের কোন সাড়া কানে এলো না তাই ফোনটা রেখে দিলাম।রাত অনেক হয়েছিলো তাই কিছুটা পথ জেগে থাকার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থান করছি।হঠাৎ জানালার কাঁচ ভেদ করে চোখে পড়লো এক বিশাল পাহাড়,আর এই পাহাড়ের অনেকটা দূরে সমতল ভূমির উপর দিয়ে আমাদের ভ্রমন বাসটি দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে।জীবনে এই প্রথম প্রাকৃতিক পাহাড় দেখলাম তাই বার বার অবাক হচ্ছিলাম আর অবাক বিস্ময়ে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য অবগাহন করছিলাম।এভাবেই এক সময় পৌছে গেলাম চট্টগ্রাম শহরে।
চট্টগ্রাম শহরটা অনেকটাই পাহাড় কেটে সাজানো হয়েছে।স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি,ধনীদের প্রাসাদ সব কিছুই পাহাড়ের উপর।এখানকার জীবন যাত্রা অনেকটাই ভিন্ন মাত্রার।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব বাসে প্রায় চার ঘন্টার পথ।কর্ণফুলী নদী পার হয়ে আমাদের বাস এক ঘন্টার পথ অতিক্রম করে প্রবেশ করলো পাহাড়ী পথে।পাহাড়ের উঁচু নিচু পথ অতিক্রম করে যখন আমাদের বাস চলছিলো তখন আমি পলকহীন দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিলাম পাহাড়ের গাছপালার সৌন্দর্য্যের পাশাপাশী পাহাড়ী মানুষদের জীবনযাত্রা।মাঝে মাঝে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছিলো পাহাড় কেটে চাষ করা আবাদী ফসলী জমিতে।মনে করে দেখো,ছোট বেলায় অবশ্যই পড়েছো পাহাড় কেটে এ ধরনের চাষকে বলা হয় 'জুম চাষ'আবার কখনো হৃদয় দিয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম পাহাড়ের নিরব কান্না।এই পৃথিবীর বেরসিক মানুষগুলো মাইলের পর মাইল পাহাড়ের গাছপালা কেটে অনেকটাই মরুভূমিতে পরিণত করেছে।পাহাড়গুলো যেন একটু ছায়ার জন্য ছটপট করছে।কষ্ট অনুভব করছিলাম পাহাড়ী মানুষগুলোকে দেখে,এদের জীবন যাত্রার মান অনেকটাই নিন্মমানের।এদের জীবন এবং জীবিকা উভয়ই সংগ্রামের।এদেরকে একদিকে যুদ্ধ করতে হয় প্রকৃতির সঙ্গে, অন্যদিকে সমাজের সঙ্গে।এভাবে যেতে যেতে আমাদের বাস যখন পাহাড়ের অনেক উঁচুতে অবস্থান করছিলো তখন হঠাৎ চোখে পড়লো সমুদ্র আর অমনিতেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ফেঁটে পড়লাম আমরা সবাই।কক্সবাজার পৌঁছানোর পর আমরা অবস্থান নিলাম সমুদ্র সৈকতে অবস্থিত হোটেল 'লজ' এ।হোটেলে আমাদের সমস্ত জিনিস পত্র রাখার পর সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সমুদ্র স্নানের।আমি ভেবছিলাম সমুদ্রে গোছল করে ফ্রেস হয়ে খেতে যাবো কিন্তু যখন সমুদ্রে নামলাম তখন আমার সম্পূর্ণ ধারনাটাই পরিবর্তন হয়ে গেলো।সমুদ্রের পানি অসম্ভব ধরনের লোনা।যখন পানি চোখে লাগছিলো তখন চোখ জ্বলছিলো,তারপরও আমাদের হৈহুল্লোরের কোন কমতি ছিলোনা।আসলে সমুদ্রের পানি শরীরে লাগলে শরীর অনেকটা আঠা এবং লবনাক্ত হয়ে যায়।সমুদ্রস্নান করে যখন হোটেলে ফিরছিলাম তখন দেখি আমার শরীরের উপর দিয়ে লবনের দানা পড়ে গেছে।হোটেলে ফিরে আবার ভালোভাবে গোসল করে স্যারের কাছ থেকে টোকেন নিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য গেলাম অবকাশ রেস্তোরায়।সেখানে আমাদের খাবার তালিকায় ছিলো ভাত,সবজি,ডাল,সামদ্রিক মাছের শুটকি ভর্তা এবং সামদ্রিক মাছের তরকারি।আমি প্রচন্ড অভুক্ত ছিলাম তাই এত পরিমান খেয়েছিলাম যে অত খাবার আমার জীবনে এক সঙ্গে কখনো খাইনি ।কারন ২১ তারিখ সন্ধ্যার পর থেকে ২২ তারিখ বিকেল ৩টা পর্যন্ত প্রত্যেকটা ছাত্র ছাত্রীর পেটে হালকা খাবার ব্যতিত কোন ভারী খাবার পড়েনি।আমার মনে হয় ঐ দিন আমাদের লাঞ্চ করাতে গিয়ে রেষ্টুরেন্ট মালিক কোন লাভ করতে পারেনি।

মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে হোটেলে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।শরীর এতই ক্লান্ত ছিলো যে,ঘুমের মধ্যে প্রচন্ড রকমের সুখ অনুভব করছিলাম তাই সুখের রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে একটু বেশী সময় লাগছিলো।ঘুম থেকে উঠে দেখি হোটেলে কেউ নেই।তাই আমি আর আমার দুই হোটেল রুমমেট একটু সেজেগুজে সৈকতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।সৈকতে এসেই তোমাকে ফোন দিলাম,ভেসে আসলো চঞ্চলা সুমনার কন্ঠ তার পরেই তুমি।তোমার কন্ঠ আর সমুদ্রের গর্জন উভয়ের সংমিশ্রনে এক অন্য রকম ভালোলাগা অনুভব করছিলাম।তোমার এবং সমুদ্রের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্য বন্ধুদেরকে ফোন দিয়ে জেনে নিলাম ওরা কোথায় আছে।সিগনালের কাছে এসে পেয়ে গেলাম নঈম স্যারসহ সবাইকে।তার পর সবাই শপিংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম বার্মিজ মার্কেটের দিকেমার্কেটে এসে সবাই কেনাকাটায় মেতে উঠলো আর আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলাম।আমার এরুপ অবস্থা দেখে নঈম স্যার জিজ্ঞেস করলো, কি স্রাবণ কেনাকাটা করছোনা যেআমি বললাম,স্যার আমার মানি ব্যাগ হোটেলে রেখে এসেছি।উনি আমার হাতে ৫০০ টাকার দুটো নোট দিয়ে বললো যাও কেনাকাটা করো। 

এরপর আমি এবং আমার বন্ধু কিছু কেনাকাটার জন্য বার্মিজ দোকানগুলোতে ঘুরতে লাগলাম।এখানকার প্রায় প্রত্যেকটা দোকানের মালিক উপজাতীয় মেয়েরা এবং বিপনন কাজটাও উপজাতীয় মেয়েরাই করে থাকে।ওদের গায়ের রং ও চেহারা বেশ আকর্ষনীয়,তাই প্রথমে ওরা ওদের সুন্দর হাসি ও চেহারা দিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে তারপর দাম হাঁকিয়ে জিনিসপত্র বেচাকেনা করে।ওদের হাসি ও সৌন্দর্যে আমিও যে মুগ্ধ হয়েছিলাম না, সে কথা বলছিনা,আমিও দারুনভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম।তাইতো আমি আর এমরান কিছুক্ষণের জন্য প্রচন্ড রকমের আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম ওদের সঙ্গে।আমাদের সঙ্গে ছিলো আরও একজন মানুষ ওয়াসিম।বেচারা বড্ড ভদ্রগোছের ও অতিমাত্রায় নিরীহ প্রকৃতির মানুষ।তাইতো কোন কথা না বলে আমাদের কার্যকলাপগুলো নিরব দর্শকের মত দেখছিলো এবং মাঝে মাঝে মেয়েদের মত লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিচ্ছিলো।ঘুরছিলাম আর ভাবছিলাম তোমার জন্য কি কেনা যায়।মনের মত কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।ইচ্ছে করছিলো সমস্ত বার্মিজ মার্কেটটাই তোমার জন্য কিনে নিয়ে যাই।যখন তোমার জন্য চন্দন,হাতির দাঁত ও হাড়গোড় দিয়ে তৈরী একটি মালা এবং খোপার কাঁটা কিনছিলাম তখন দোকানের উপজাতীয় মেয়েগুলো বলছিলো,বাবু এগুলো কাহার জন্য কিনছিস?আমি ওদের মত করেই বলার চেষ্টা করে বলেছিলাম, হামার একটা মানুষ আছে,তাহার নাম শ্রাবন্তী, আমার খুবই প্রিয় মানুষ।উত্তরে ওরা বলেছিলো,'লিয়ে নে বাবু, ও খুবই খুশী হুবে'
তবে তোমার খোপার কাঁটা কেনার পর মনে হলো,কাঁটা পড়তে খোপার প্রয়োজন হয় কিন্তু তোমার চুলেতো খোপা হবেনা, কারন তোমার লম্বা সুন্দর চুলগুলো তুমি কেটে ছোট করে ফেলেছো।তাই খোপার কাঁটা পাঠালাম না। শ্রাবন্তী    চুলগুলোর স্বাধীনতা খর্ব না করে এক বার ছেড়ে দাওনা, ওরা ওদের ইচ্ছে মত বড় হোক। 

দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাড়ালাম,মনে হলো রোকেয়া আপু,খানিকক্ষণ পরখ করে দেখার পর নিশ্চি হলাম।তাই কোন কথা না বলে চুপি চুপি ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, আর উনি মুখ ফেরাতেই আমাকে দেখে হতবাগ,তারপর আলাপ হলো।উনি বায়ু পরিবর্তনের জন্য এখানে এসেছে।আমার কেনা জিনিসগুলো দেখে আপু খুশী হলো এবং আমি জিনিসগুলো যে দোকান থেকে কিনেছি ঐ দোকানে ওনাকে নিয়ে যেতে বললো।দোকানে গিয়ে উনি আমার কেনা জিনিসগুলো কিনলো।তোমার জন্য একটা চুলের ক্লিপ কিনতে চেয়েছিলাম কিন্ত আপুর পছন্দ না হওয়াতে কেনা হলোনা।
এবার রোকেয়া আপু সম্পর্কে একটু বলি,উনি তোমাদের কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করছেন।আমরা এক সাথে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছি।আপুর সাথে আমার ভালো একটা বন্ধুত্ব সম্পর্ক রয়েছে এবং উনি আমাকে খুব আদর করেন।

বার্মিজ মার্কেট থেকে হোটেলে ফিরতে আমাদের অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো।ভেবেছিলাম রাতের খাবারটা সেরে পরিপূর্ণ একটা ঘুম দেবো কিন্তু তা আর হলোনা।রাত ১টার দিকে নঈম স্যার সমুদ্র সৈকত থেকে খবর পাঠিয়েছেন আমাদেরকে সৈকতে যাওয়ার জন্য,তাই যেতে হলো।
স্যারের সঙ্গে যখন সমুদ্রের তীর দিয়ে হাঁটছিলাম তখন দেখলাম সমুদ্রের এক ভিন্ন রুপ।সমুদ্রের ভাঁটার কারনে পানি ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছিলো।ভাবছিলাম,এই পানি নিজের প্রয়োজনে সমুদ্রের তীরকে ভালোবেসে তীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্পর্শ করে।তীরকে আদর দিয়ে,ভালোবাসা দিয়ে তীরকে সিক্ত করে দেয়।আবার সময় হলে স্বার্থপরের মত তীরকে ছেড়ে চলে যায়।আমার কানে মিনি টেপ রেকর্টারে বাজছিলো ছামিনা চৌধুরীর একটি গান'ফুল ফোটে ফুল ঝড়ে,ভালোবাসা ঝড়ে পড়ে না,দিন যায় দিন আসে সেতো ফিরে আসে না'তীরের বিরহ উপলব্ধি করে,গানটা আমার হৃদয়ের সাথে মিশে যাচ্ছিলো।আর বার বার মনে পড়ছিলো তোমার কথা।তীরের মতই নিজেকে বড়ই হতভাগা মনে হচ্ছিলো, আর মনে প্রশ্ন জাগছিলো, তুমি কেন আমার পাশাপাশী হাঁটছনা? তাই সমস্ত দ্বিধা এবং দ্বন্দকে ঝেড়ে ফেলে তোমাকে ফোন দিলাম,বায়ু তরঙ্গে ভেসে আসলো তোমার শান্ত কন্ঠ স্বর।সব কিছু মিলে বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছিল। আর এই প্রশান্তির রেশটুকু বুকে নিয়েই তীরকে ছেড়ে ফিরে এলাম হোটেল কক্ষে,শরীরটা এড়িয়ে দিলাম বিছানায় আর হারিয়ে গেলাম এক গভির ঘুমের রাজ্যে.........................


পরের দিন অর্থাৎ ২৩ তারিখ, আমাদের ভ্রমন তালিকায় ছিলো 'সেন্ট মার্টিন' দ্বীপ।এই দ্বীপকে আরো দুটি নামে ডাকা হয়,১:প্রবাল দ্বীপ২:নারিকেল জিনজিরা।
সমুদ্রের মৃত শৈবালগুলো জমাটবদ্ধ হয়ে প্রবাল সৃষ্টি করে।আর এই দ্বীপের সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে অসংখ্য প্রবাল যা জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে দ্বীপে।অন্যদিকে দ্বীপের প্রায় সমস্ত অংশ জুড়েই রয়েছে অসংখ্য নারিকেল গাছ, তাই এই দ্বীপকে নারিকেল জিনজিরা বলা হয়।কক্সবাজার থেকে টেকনাফ গিয়ে জাহাজে অথবা ট্রলারের মাধ্যমে নারকেল জিনজিরায় পৌছাতে হয়।আর কক্সবাজার থেকে টেকনাফের দুরত্ব চলন্ত বাসে প্রায় তিন ঘন্টার পথ এবং পাহাড়ী পথও অনেক উচুনিচু।আমরা যখন পাহাড়ী পথের টিলাগুলো অতিক্রম করছিলাম তখন বাস এমন ভাবে লাফিয়ে উঠছিল যে বাসের পেছনে বসা আমাদের সবার হাড়গোড় ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়ার উপক্রম।তোমাকে ফোন দেবার প্রচন্ড ইচ্ছে জাগছিলো কিন্তু মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিলনা।
পাহাড়ী পথ অতিক্রম করার পর যখন সমতল ভূমি দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছিলো বড় বড় লবন চাষের মাঠ।সমুদ্রের পানি আটকিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এখানে লবন চাষ করা হচ্ছে।
দেখছিলাম আর জীবনের কল্পনা ও কৌতুহলগুলোর একের পর এক মরণ হচ্ছিলো।অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যোগ হচ্ছিলো নতুন মাত্রা।
চলতে চলতে হঠাৎ চোখ আটকে গিয়েছিলো রাস্তার পাশ দিয়ে অবস্থানরত মায়ানমার সরকার কর্তৃক বাংলাদেশে পুশ ইন করা বাস্তুহারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবেতর জীবন যাপন দেখে।এদেরকে অনেক দিন আগে পুশ ইন করা হয়ছে কিন্তু এখনো পুশ ব্যাকের কোনো উদ্যেগ নেওয়া হয়নি ফলে এই সর্বহারা মানুষগুলো এখন না বাংলাদেশর নাগরিক , না আছে মায়ানমারে তাদের অধিকার।এই পৃথিবীতে আমরা যারা সভ্যতার বড়াই করি,মানবতার কথা বলি,ওদেরকে দেখলে আমাদের এই অহংকার নিমিষেই ম্লান হয়ে যাবে।ঘৃণা হচ্ছিলো এই পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থার প্রতি।এই পৃথিবীতে একটা কুকুর যে অধিকার নিয়ে বেঁচে আছে ,ওদের সে অধিকারটুকুও লুন্ঠিত।এই অবস্থার পরিবর্তণ আদৌ কি হবে? ভাবছিলাম এই অধিকার বঞ্চিত মানুষগুলো যখন প্রয়োজনের তাগিদে রাইফেল তাক করে সমাজপতিদের বুকের উপর তখন আমাদের মত মানুষেরা সমাজপতিদের পক্ষ নিয়ে ওদের নামের পাশে সেঁটে দেই জঙ্গী,দেশদ্রোহী ইত্যাদি তকমা।

ভাবনা এবং যাত্রার মধ্যে দিয়ে এক সময় পৌঁছে গেলাম আমাদের
কাঙ্ক্ষিত সাগরতরী 'কেয়ারী সিন্দবাদ' জাহাজে।আমাদের জাহাজ সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে যাত্রার শুরুতে জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রত্যেক ভ্রমন পিপাশুদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ,নদীর পার দিয়ে অবস্থিত পাহাড় ও জীব বৈচিত্র সম্পর্কে অবহিত করলেন।জাহাজ যখন নাফ নদীর মধ্যে দিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলছিলো তখন হৃদয় আমার বার বার নেচে উঠছিলো,রবীন্দ্রনাথের গানের মতই "হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে"।


পাশেই বার্মার সুউচ্চ পাহাড় আর এক পাশে নদীর কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সবুজ গাছপালা বেষ্টিত পাহাড়আর এর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী মিলে প্রকৃতি এক ভিন্ন মাত্রার আবহের সৃষ্টি করেছে।প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যের মধ্যেই অবস্থান করছিলাম আমরা। আসলে এই সৌন্দর্য বর্ণনা করার মত ভাষা এবং শব্দ আমার জ্ঞানের ভান্ডারে নেই।শুধু এতটুকু বলতে পারি,কোন চিত্রকর যখন কোন ছবি আঁকে তখন তার মনের মাধুরী মিশিয়ে ইচ্ছে মত রং তুলির আঁচড় কেটে সৃষ্টি করে অনিন্দ্য সুন্দর চিত্র শৈলী।আমার মনে হচ্ছিলো,সৃষ্টিকর্তা ঠিক চিত্রকরের মতই তার সমস্ত সৌন্দর্য ডেলে দিয়ে,আনমনে নিজের হাতে এমন কীর্তি  সৃষ্টি করে প্রমান করেছেন,তিনি সুন্দর।তাইতো যখন তুমি ফোনে বলছিলে, কেমন আছি? আমি ভাষা হারিয়ে বলছিলাম,স্বর্গে আছি,স্বর্গে।ধীরে ধীরে আমাদের সাগরতরী প্রবেশ করলো সমুদ্রের বিশাল জলরাশির মাঝে।চারিদিকে শুধু জল আর জল ছাড়া চোখে কিছুই ধরা পড়ছিলোনা।ধু ধু সমুদ্রের বিশাল ঢেউ আঁচড়ে পড়ছিলো কেয়ারী সিন্দবাদের গায়ে। জাহাজ সমুদ্রের ঢেউয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যখন  আবার  নিচে নেমে যাচ্ছিলো তখন মনে হচ্ছিলো জাহাজ যেকোনো সময় ডুবে সমুদ্রের তলদেশে চলে যাবে।জাহাজের এমন উন্মাতাল নৃত্য দেখে মেয়েরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু আমরা ছেলেরা সবাই দারুন এক এ্যাডভেঞ্চারে মেতে উঠেছিলাম।জাহাজে এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ দূরে চোখে ঝাপসা ঝাপসা কিছু একটার অস্তিত্ব ধরা দিলো এবং ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে এলো।আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবাল দ্বীপের সন্নিকটে চলে এসেছি।


দ্বীপে পৌঁছানোর পর জাহাজ থেকে নেমে সবাই ফটো সেশন করলাম।এখানে খাবার পানি খুবই দুষ্প্রাপ্য তাই সবাই তৃষ্ণা মিটিয়ে থাকে ডাবের পানি পান করে।নাকিকেল জিনজিরায় এসে যদি নারিকেল না খেয়ে ফিরে যাই তাহলে সেটা একেবারেই বেমানান হয়ে যায়।তাই নারিকেলের পানি পান করে আর নারিকেল খেয়ে শরীরের ক্লান্তি কিছুটা দূর করলাম।আমার পরনে ছিলো প্যান্ট শার্ট ও জুতা,এমন জায়গায় এমন পোশাকে নিজেকে ফুলবাবু মনে হচ্ছিলো তাই পোশাক পরিবর্তন করে শর্ট প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে নিলাম।কিছুক্ষণ খালি গায়ে বেলা ভূমির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শরীরে দ্বীপের বিশুদ্ধ হাওয়া লাগালাম।মাঝে মাঝে ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের মনোমুগ্ধকর সামদ্রিক ঝিনুক,শামুক ও প্রবাল এনে বলছিলো 'স্যার কিননা দুইডা ট্যহা দ্যান'সমুদ্রের কূলে পড়ে থাকা পাথরগুলো দ্বীপের সৌন্দর্যের নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে,মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিলো তীরের পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা ছোট ছোট কেয়াবন।

সেন্ট মার্টিন একটি ইউনিয়ন আর দ্বীপের এই নামকরণ করা হয়েছে ইউরোপিয়ান এক ব্যক্তির নামে।এখানকার স্বল্প শিক্ষিত ও ধর্মভীরু মানুষদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস মৎস শিকার ও মৎসকে শুটকিতে প্রক্রিয়াকরণ।
দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ানোর পর আমরা কিছু সময় অবস্থান করেছিলাম কথা সাহিত্যিক ডঃ হুমায়ুন আহম্মেদের সমুদ্র বিলাসে।সমদ্র বিলাশ নিয়ে আমার কল্পনায় যেমন ছিলো কিন্তু বাস্তবের সাথে তেমন কোন মিল খুজে পেলাম না।তোমাকে ফোন করার প্রচন্ড ইচ্ছে থাকার সত্বেও দ্বীপে কোন একটেল নেটওয়ার্ক না থাকায় তোমাকে ফোন করা হলোনা।
দ্বীপের হৈ হুল্লোর,ঘোরাঘুরি,ছবি তোলা ও কেনাকাটা শেষ করে এখানকার একটা অভিজাত রেস্টুরেন্টে আমরা খাওয়া দাওয়ার পর্বটা সেরে নিলাম।এরপর দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল ছুই ছুই ঠিক এমনি এক সময় আমরা এই প্রবাল দ্বীপের ক্ষণিকের মমতার বন্ধন ছিন্ন করে আবার যাত্রা করলাম আমাদের অপেক্ষায় থাকা সাগরতরী কেয়ারী সিন্দবাদের দিকে.........................


সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফ ফেরার পর আমরা শপিং করার জন্য গিয়েছিলাম টেকনাফে অবস্থিত একটি বার্মিজ মার্কেটে।এখান থেকে তোমার জন্য কিনলাম তেতুল ক্যান্ডি,বড়ই আচার এবং বার্মিজ বাদাম।কেনাকাটা শেষ করার পর দিনের আলোকে বিদায় দিয়ে প্রকৃতি যখন হালকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে ঠিক তখন কক্সবাজারের ফেরার উদ্দেশ্যে সবাই বাসে উঠে বসলাম।
বাস যখন অন্ধকার বন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ী পথ অতিক্রম করতে লাগলো ঠিক তখন শিক্ষা সফর আয়োজক কমিটি লটারীর লাকি কুপন বিক্রি শুরু করলো।আমার কুপন কেনার তেমন কোন ইচ্ছে ছিলোনা কিন্তু নঈম স্যার যখন বললো 'শ্রাবণ, শ্রাবন্তীর জন্য কি কুপন কিনেছো?'তখন বাধ্য হয়েই তোমার জন্য ১০ টাকা দিয়ে একটি কুপন কিনলাম।কেনার পর আমার পাশে বসা বন্ধুদের বললাম 'দেখিস আমি কিছুনা কিছু পাবোই'যা বললাম ঠিক তাই হলো, কক্সবাজার ফেরার পর যখন আমাদের হোটেলের লবিতে রাত ১২ টার দিকে লটারীর ড্র শুরু হলো তখন কুপনের তিনটি নম্বর উঠানোর পর বক্স থেকে উঠে এলো তোমার ৩৩ নম্বরের কুপনটি।আর উপহার হিসেবে পেলাম একটি নেইল কার্টার।খুব ভালো লাগছিলো, কারন জীবনের এই প্রথম লটারীর টিকেট কিনে কিছু পেলাম তাও আবার কুপনটি তোমার নামে কেনা।খুশীতে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে গিয়ে রাত একটার দিকে তোমাকে ফোন দিলাম কিন্তু তোমার ওপারের কোন সাড়া পেলাম না।মোবাইলের কল লিষ্ট চেক করে দেখি তুমি চার বার কল দিয়েছো আমাকে।ভাবলাম কল দিয়েছো কিন্তু আমি ফোনে সাড়া দেইনি তাই হয়তো রাগ করেছো।সে জন্য আমার ফোনেত্ত সাড়া দিচ্ছোনা।আসলে এতটা হৈ হুল্লোরের মধ্যে ছিলাম যে তোমার ফোন কল আমি টেরই পাইনি।
শ্রাবন্তী আমার মনের অনেক কথাই তোমার অজানা।আমার যদি কখনো মনে হয়,তুমি আমার উপর কোনো কারণে রাগ করেছো,কিংবা তোমার কোন আচরণ যদি আমার কাছে এলোমেলো মনে হয় তাহলে আমার সমস্ত শরীরে কষ্ট ছড়িয়ে পড়ে।মাঝে মাঝে ভয় হয়,যদি কখনো কোন ক্ষুদ্র,অতি সামান্য ও মামুলী কোন বিষয়ে আমাকে বড় ধরনের ভুল বুঝো।আমি জানি,কারো ভুল অথবা অভিমান ভাঙ্গানোর জন্য যে গুনাবলী থাকার প্রয়োজন, তা আমার মধ্যে নেই।তাই অনেকে আমাকে মনে করে আমি একজন কঠিন হৃদয়ের মানুষ কিন্তু আমার হৃদের মধ্যেও যে একটি শান্ত এবং সুপ্ত মনের বসবাস অনেকেরই অজানা।

২৪ তারিখে আমরা রাঙ্গামাটির চিম্বুক পাহাড় পরিদর্শনের জন্য কক্সবাজার থেকে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।কক্সবাজার থেকে ১০০ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করার পর যখন আমরা গন্তব্যস্থল চিম্বুক পাহাড় থেকে ২২ কিঃমিঃ দূরে তখন প্রকৃতি আমাদের সাথে শুরু করলো এক বিরুপ আচরন।শুরু হলো গুরি গুরি বৃষ্টি।রাস্তার এক পাশে বাস থামিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছিলো,কি করা যায়।বৃষ্টির গতি যদি আরো বেড়ে যায় তাহলে পাহাড়ী পথ পিচ্ছিল হয়ে যাবে, আর তাতেই ঘটতে পারে যে কোনো দুর্ঘটনা, এই ভেবে চিম্বুক পরিদর্শন বাতিল করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমরা আজকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র বন্দর ও ফয়েজ লেগ দর্শন করবো।এর পর আমাদের বাস দিক পরিবর্তন করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো, কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস!কর্ণফুলী নদী পার হতে গিয়ে ফেরির বিলম্বিত সার্ভিসের কারনে কালুর ঘাটেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো আর চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি।এরুপ পরিস্থিতিতে আমরা অবস্থান নিলাম শহরের একটি অভিজাত হোটেল 'মিসকা'তে। হোটেলে নৈশ ভোজের পর্বটা শেষ করার পর আমাদেরকে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হলো পতেঙ্গা বন্দরে কিন্তু বন্দরে গিয়ে নিকষ কালো অন্ধকার ব্যতিত আর কিছুই চোখে ধরা দিচ্ছিলো না।একদিকে রাত অন্যদিকে বৃষ্টি তাই ফয়েজ লেগে যাওয়ার মত উৎফুল্লতা কারোর মধ্যেই ছিলোনা।ফলে ফয়েজ লেগ দর্শনও ডাষ্টবিনে ছুড়ে ফেলে ফিরে এলাম হোটেল মিসকায়।

মিসকাতে আমরা অবস্থান করবো রাত ১২টা পর্যন্ত, কিন্ত বাকীটা সময় কি করা য়ায়,এই ভেবে আয়োজন করা হলো মিসকার অডিটোরিয়াম রুমের সাউন্ড সিস্টেমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করলাম।হঠাৎ মাথায় এলো এক নতুন ফন্দি,তোমাকে আমাদের এই অনুষ্ঠানে গান গাইতে হবে এই ভেবে তোমাকে ফোন দিলাম কিন্তু তুমি কিছুতেই রাজি হলে না।তাই এবার ফোন দিলাম তোমার রুমমেট সুমনাকে।সুমনার মধ্যে লাজুকতা কম,চঞ্চলতা বেশী।সুমনা গান গাইলো 'আমার সোনার ময়না পাখী' আর মোবাইলের লাউড স্পিকারে মাইক্রোফোনের মাধ্যমে গান শুনলো অডিটোরিয়ামের সকল ভ্রমনার্থী।

দারুন ভাবে মুগ্ধ হলো সবাই।এমন একটা ব্যতিক্রম ব্যাপার সাড়া ফেলে দিলো সমস্ত ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে।সবাই সুমনাকে অভিন্দন জানানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো, কিন্তু সুমনার মোবাইল কোথায় কি এমন জরুরী কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে টানা একঘন্টা চেষ্টা করেও কেউ তার মোবাইলে নম্বরে ঢুকতে পারলো না।মনে হচ্ছিলো,মেয়েটা কিছু একটা হারাচ্ছে।কিছু কিছু প্রশংসা হাত পেতে নিতে হয় যা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে,সামনে এগিয়ে যাওয়ার আত্নবিশ্বাস বাড়ায়।সুমনা তেমনি কিছু হারালো।সুমনা যদি উপস্থিত হয়ে দেখতো, তাৎক্ষণিক ভাবে ও কতটা প্রিয় হয়ে উঠেছে সবার কাছে তাহলে খুশীতে আত্মহারা হয়ে যেতো।আমাদের অনু্ষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলো ম্যাকতা ও এ্যান্জেলিনা নামে দুই অস্ট্রেলিয়ান বিদেশী তরুণী।ওরাও দারুনভাবে উপভোগ করেছিলো আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।আর এই অনুষ্ঠানর মধ্য দিয়েই ইতি টানা হলো আমাদের মধুময় ভ্রমনের সমস্ত কার্যক্রম।প্রাত্যাহিক জীবনের টানে রাত ১২টা৩০ মিনিটে আমরা চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে........বাস তার চলন্ত গতি থামিয়ে দিলো ঢাকাতে কিন্তু জীবনের চলমান গতি চলছে  জীবনের নিয়মে..........................

 শ্রাবণ। 
০১/০৩/২০০৫

অন্ধ গলির জীবন


(একজন লিপির আত্নকথন)
মাঝে মাঝে মনটা বড় উদাস হয়ে যায়।একাকিত্ব ঘিরে ধরে আমার চারিদিকে।জীবনের সেই কালো দিনগুলো আমার সব কিছুকে গোল পাকিয়ে দেয়।ভাবি, আমার এই রক্ত মাংশের দেহ হয়তো এই সভ্য সমাজে ফিরে এসেছে কিন্তু মনটা কি ফিরে পাবোনা?সেই কৈশরের হারিয়ে যাওয়া পবিত্র দিনগুলির মত,যে সময় আমার ভাবনা ছিলো উজ্জ্বল উচ্ছল।আমার জীবনটাতো এমন হওয়ার কথা ছিলো না,স্বপ্ন ছিলো,জীবন চলার পথ অতিক্রম করবো বহমান নদীর মত, যে চলার পথে থাকবে শুধুই আনন্দ আর আনন্দ।কিন্তু কেন আমার চলার পথে অশ্রু আর কাঁটায় ভরা।আমি আজ খাঁচায় বন্দী বাবা মায়ের অবিশ্বাসের পুতুল।মাঝে মাঝে মনটা সন্তান হারা বাঘিনীর মতো হিংস্র জানোয়ার হয়ে যায়।ঘৃণা হয় এই সমাজ ব্যবস্থার উপর।টেনে হিচরে খুলে দিতে ইচ্ছে করে প্রেমিক নামধারী ভদ্রবেশী প্রতারকদের মুখশ।যারা আমার জীবনের সমস্ত স্বপ্নকে একদিন মাটি চাপা দিয়ে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো অন্ধকার জগতে।

আমি ছিলাম যশোর জেলা শহরের দুই ভাই বোন ও বাবা মায়ের সংসারের এক মাত্র আদরের কন্যা।বাবা আমার নাম রেখে ছিলো লিপি।বাবা মা দুঃখ কি কখনো বুঝতে দেয়নি।দুই ভাই বোনের প্রত্যাশার অপূর্ণতা রাখেনি কখনো।সব মিলিয়ে আমাদের সংসারটা ছিলো ভালোবাসা আর সুখে পরিপূর্ণ একটি ছোট্ট নীড়।এই সুখ আর ঐশর্য্যের মধ্যে দিয়ে একদিন শৈশব কৈশরের খোলশ ঝেড়ে ফেলে পদার্পন করলাম যৌবনে।যৌবনে অন্য আট দশটি মেয়ের মত আমিও স্বপ্ন দেখেছি প্রেমিকের ভালোবাসা পাওয়ার।কল্পনা তাড়িত মন ভেসে বেড়াতো মেঘের ভেলায়। স্বপ্নের মানুষটির জন্য অধির হয়ে থাকতাম সব সময় ।ভাবতাম,আমার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে হারিয়ে যাবো কল্পলোকে, যেখানে থাকবেনা কোনো সংঘাত,থাকবে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা। একদিন কল্পনার মানুষটি বাস্তবতায় রুপ নিয়ে আবির্ভাব ঘটলো আমার জীবনে।ওর নাম পার্থ।ওর ডাকেই সাড়া দিয়ে সমস্ত দেহ প্রাণ মন সপে দিয়েছিলাম শুধু ওর ভালোবাসার জন্য।এক বাঁধ ভাঙ্গা ভালোবাসায় হাবুটুবু খেয়েছি দিনের পর দিন।ওই সময়টাতে আমার সমস্ত চিন্তা চেতনায় পার্থকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনি।ওর যে গুনটি আমাকে সব চেয়ে বেশী মুগ্ধ করতো সেটি হলো ওর শুদ্ধ করে গুছিয়ে কথা বলা।।ওর মুখের একটু মিষ্টি কথা শোনার প্রতিক্ষার প্রহর গুনে আমার দিনগুলো পার হয়ে যেতো।কতো দিন কলেজ ফাঁকি দিয়ে পার্থের হাতে হাত রেখে পার্কের লেকের ধারে কাঁটিয়ে দিয়েছি ঘন্টার পর ঘন্টা বুঝতেই পারিনি। এভাবেই একটা ঘোরের মধ্যে জীবন থেকে কেটে গিয়েছে ছয়টি মাস।

এর পর থেকে পার্থের মধ্যে লক্ষ্য করতে লাগলাম নতুন একটি লক্ষণ,ও মাঝে মাঝে আমার কাছে টাকা চাইতো।ও চেয়েছে এই ভেবে কোন কিছু না জিজ্ঞেস করেই ওকে টাকা দিতাম।কিন্তু ব্যাপারটা যখন নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে দাড়ালো, তখন আমার মধ্যে একটু একটু করে সন্দেহ বাসা বাঁধতে লাগলো।কৌতুহলের জায়গা থেকে অনুসন্ধান করে জানতে পারি পার্থ মাদকাসক্ত ও জুয়া খেলার প্রবনতাও রয়েছে।ব্যাপারটা জানার পর নিরবে নিভিতে কেঁদেছি অনেক দিন।আমার ভাবতেই কষ্ট হতো যে আমার ভালোবাসার মানুষটি অন্ধকার জগতের বাসিন্দা।অনেক দিন ক্ষোভে দুঃখে পার্থের সাথে দেখা করিনি।নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি ওর জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে।কিন্তু ওর ভালোবাসা আমার দেহ মনকে এতটাই আচ্ছাদিত করে ফেলেছিলো যে বার বার নিজের কাছে নিজেই হেরে গিয়েছি।
এক দিন আমার মাথায় হাত রেখে পার্থ শপত করে বলেছিলো, এখন থেকে সে আর অন্ধকারে পা বাড়াবে না,তবুও যেন ওর জীবন থেকে আমি মিলিয়ে না যাই।সেই দিন ওর মধ্যে আমার জন্য যে আকুতি দেখেছিলাম, যে হাহাকার দেখেছিলাম আমি আর ফিরে আসতে পারিনি ওর জীবন থেকে।নতুন এক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে আমরা ভালোবাসার নতুন দিগন্তে আবার পথ চলতে শুরু করলাম।এর পর থেকে পার্থ আমার কাছে আর টাকা চাইতো না।ওর আচরনে পরিবর্তনের এক নতুন ধারা লক্ষ্য করলাম। বাবা মায়ের অগোচরে আমার আর পার্থের সম্পর্ক আরো এক বছর অতিবাহিত হলো।

এর মধ্যে বাবা আমার জন্য অন্য একটি ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে।ছেলে ঢাকাতে ব্যবসা করে।অর্থ বিত্ত ও বৈভব সবই আছে।বাবা বিয়ের পাকা কথাও ছেলে পক্ষের সাথে চূরান্ত ফেলে।ধীরে ধীরে বিয়ের চূরান্ত লগন ঘনিয়ে আসতে লাগলো।আর আমার পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো।কি করবো কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলাম না।পার্থকে সব কিছু খুলে বললাম একটা উপায় বের করার জন্য।আমি নিশ্চিত ছিলাম যে পার্থের ব্যাপারে বাবা মাকে বললে কখনোই রাজী হবে।বাবা কখনোই চাইবেনা বিয়ের চূরান্ত কথা তুলে নিয়ে পার্থের মত বেকারের হাতে আমাকে তুলে দিতে।আর পার্থের মাদকাসক্তের ব্যাপারটা যদি কোন ভাবে জেনে ফেলে তাহলে হিতে বিপরিত হওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি।তাই বাবা মাকে পার্থের বিষয়টা বলার ব্যাপারে সেদিন সাহস করিনি।পার্থও সাফ জানিয়ে দেয় এই মূহুর্তে বিয়ের ব্যাপারে তার পরিবারের সাথে কথা বলা সম্ভব নয় তবে আমাকে ছাড়া সে বাঁচবে না।পার্থ একটি উপায় বের করে বলে,লিপি চলো আমরা পালিয়ে বিয়ে করে কিছু দিন লুকিয়ে থাকি দেখবে এক সময় উভয় পরিবারই আমাদেরকে মেনে নেবে।পার্থকে জীবন থেকে না হারানোর আশায়, কোন উপায় না পেয়ে আমার বিবাহের চূরান্ত দিনের ২দিন আগে পার্থের কথা মত, সরল বিশ্বাসে মায়ের সোনার অলংকার,সিন্ধুক থেকে ত্রিশ হাজার টাকা ও আমার প্রয়োজনীয় কাপড় চোপর নিয়ে গভীর রাতে পার্থের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
পার্থ একটি মাইক্রোবাস বাস ঠিক করে রেখেছিলো, ঐ মাইক্রোবাসেই আমরা রওয়ানা হই এবং ভোর রাতে এসে পৌঁছাই এক নদী বন্দরে।নদী বন্দরের ডান পাশে ছোট ছোট ঝুপরি ঘর বিশিষ্ট বিশাল চরপাড়া গাঁও।ঐ পাড়াগাঁও দেখিয়ে পার্থ আমাকে বলে, এখানে আমার এক বোন থাকে,ঐ বোনের বাড়ীতেই এখন থেকে আমরা সংসার পাতবো।একটা বাঁশের সাঁকো পার হয়ে পার্থ আমাকে দ্রুত পাড়া গাঁয়ের একটি বাড়ীতে নিয়ে যায় এবং বলে এইটাই আমার বোনের বাড়ী।একটা ঘরের মধ্যে আমাকে বসিয়ে রেখে পার্থ প্রায় চল্লিশ বছরের বয়স্ক এক মহিলার সাথে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলতে থাকে,আলাপের এক পর্যায়ে মহিলা পার্থকে অনেকগুলো টাকা দেয়।আলাপ শেষ করে পার্থ আমার কাছে এসে বলে,লিপি নতুন সংসারের জন্য অনেক কিছু কিনতে হবে,অনেক টাকার প্রয়োজন তার উপর বিয়ের কাজটাও সেরে ফেলতে হবে,কিছুতেই দেরি করা ঠিক হবে না,আমার কাছেতো তেমন কোন টাকা পয়সা নেই,তোমার কাছে যা টাকা পয়সা ও স্বর্ণের অলংকার আছে আমাকে দিয়ে দাও,প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসি আর কাজী ডেকে নিয়ে আসি।আমি পার্থকে নগদ পঁচিশ হাজার টাকা ও স্বর্ণালংকর যা ছিলো সব ওর হাতে তুলে দেই। "আমি সব কাজ কর্ম সেরে যত দ্রুত সম্ভব কাজী সাথে করে নিয়ে ফিরে আসবো, তুমি তৈরী থেকো" এই বলে পার্থ আমাকে রেখে চলে যায়।

পার্থ চলে যাওয়ার এক ঘন্টা পর পার্থের কথিত বোন এসে আমাকে বলে "এই মেয়ে তোমাকে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে,খবরদার এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবে না,চেষ্টা করলে পরিণাম ভালো হবেনা,আমাদের লোক চারদিকে ছড়িয়ে আছে নিশ্চিৎ ধরা পড়ে যাবে,অনেক দূর থেকে যাত্রা করে এসেছো আজ ভালোভাবে বিশ্রাম নাও আগামী কাল থেকে ঠিক মত কাজ শুরু করে দেবে"

.... মহিলার কথাগুলো শোনার পর আমার বুঝতে খুব একটা দেরি হলোনা যে আমি কোন নড়কপুরিতে এসে পৌঁছেছি।মহিলা কিছু উপদেশ বানী শুনিয়ে বললো,এখানে যে পুরুষেরা আমাদের কাছে আসে তারা আমাদের কাছে মনিবের মত,এদের সাথে কখনো খারাপ আচরন করবেনা যতটা সম্ভব ভালো ব্যবহার করবে যাতে পুনরায় তোমার কাছে আসে আর এখন থেকে তোমার নাম হবে মহুয়া।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা,নিকোশ কালো অন্ধকার ভেদ করে পূর্ব গগনে সূর্য্য উঠলো কিন্তু পার্থ আর আমার কাছে ফিরে এলোনা।মনে মনে ভাবতে লাগলাম পার্থ তুমি জুয়ারী ছিলে আমি জানতাম কিন্তু তুমি একদিন আমার মাথায় হাত রেখে শপত করে বলেছিলে,তুমি আর অন্ধকারে পা বাড়াবে না কিন্তু সেই তুমিই আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে আমার জীবন নিয়ে জুয়া খেললে!আমিতো ভালোবাসা ছাড়া তোমার কাছে আর কিছুই চাইনি, সমস্ত কষ্ট মেনে নিয়েইতো তোমার হাত ধরে সম্পূর্ণ আস্থা রেখে পথে বেড়িয়ে পড়লাম কিন্তু তুমি কেন একটা জীবন,একটা স্বপ্নের সাথে ঘাতকতা করলে?কোন কিছুরই উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলামনা,জীবনের কোন হিসেব মেলাতে পারছিলামনা আমি।

জানতে পারলাম এই পল্লীর নাম দৌলতদিয়া পতিতা পল্লী,রাজবাড়ী জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর পতিতা পল্লী।আমার কোন আকুতি,কোন অনুনয়,কোন অনুরোধ কোন কিছুতেই মন গলাতে পারলোনা পাথর হৃদয়ের আমার পতিতা সর্দারানীর,মুক্তি মিললোনা আমার,আমার নতুন পরিচয় হলো মহুয়া পতিতা নামে,জীবনের যাত্রা শুরু হলো অন্ধকার জগতের এক নতুন অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে।

জীবনে স্বপ্ন দেখেছি একটি বাসর শয্যা হবে,অনেক যত্নে সংরক্ষিত সতিত্ব সমর্পণ করবো প্রেমিক পুরুষের হাতে কিন্তু সেই সতিত্ব লুটে নিলো মানুষ রুপি এক আধমরা হিংস্র জানোয়ার।হায়রে নিয়তি.....!অনেক বার আত্নহত্যার চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হয়নি।

এই পল্লীতে প্রতিদিন অর্থের বিনিময়ে আমার দেহ হাত বদল হতো ভদ্রলোকের খোলশ লাগানো বিভিন্ন পরুষদের হাতে আর রাত হলে মাঝে মাঝেই আমার সর্দারানী আমার ঘরে ডুকিয়ে দিয়ে যেতো বিভিন্ন বয়সী পুরুষ।এভাবেই চলতে লাগলো আমার ধারাবাহিক জীবনপঞ্জি।আমার বাড়িওয়ালী আমার দেহ বিকিয়ে যে অর্থ আয় করতো তার বিনিময়ে আমার কপালে জুটতো তিন বেলা পেটপুরে খাবার আর বাজারের ভোগ্য দেহটাকে সাজিয়ে রাখার বস্ত্র ও প্রসাধনী সামগ্রী। রাতে যে সব পুরুষ আমার সাথে থাকতো তাদের অনেকের কাছে হাত জোর করে মিনতি করে বলেছি,'ভাই আমাকে বাঁচান, আমি এখানে প্রতারনার শিকার,দয়া করে আমাকে মুক্তি দিন এই নরকপুরি থেকে'।আমার আর্তনাদে কিঞ্চিৎ পরিমান হৃদয় গলেনি নারী পিপাশু পুরুষদের।বরং সাড়া রাত ভোগ আনন্দে মেতে উঠে ভোর হলে ভদ্রলোকের লেবাজ লাগিয়ে ফিরে যেত আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজে।এই পতিতা পল্লীর জীবন থেকে চিনতে পেরেছি আমাদের সভ্য সমাজের দিনের আলো এবং রাতের অন্ধকারের চরিত্র।

রাতের পুরুষদের কাছে মুক্তির জন্য সাহায্যের বিষয়টা আমার বাড়িওয়ালী জেনে ফেলার পর থেকে আমার উপর মাঝে মাঝেই চলতো শারিরিক নির্যাতন, সেই সাথে আমার উপর শকুন দৃষ্টি আরো বাড়িয়ে দেওয়া হলো।

এক রাতে বাড়িওয়ালী আমার ঘরে আনুমানিক পঁচিশ বছরের এক যুবককে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায়।যুবকটি ঘরে ঢুকেই দীর্ঘক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর নিজে থেকেই আমার সম্পর্কে জানতে চায়।এই পল্লীতে যত রাত বিভিন্ন পুরুষের সাথে রাত কাটিয়েছি কেউ নিজ থেকে আমার সম্পর্কে জানতে চায়নি।যুবকটিকে দেখে আমার মধ্যে অন্য রকম ভালোলাগা এক অনুভূতি অনুভব করলাম।তাই আমার সমস্ত ঘটনা,সমস্ত বেদন ব্যক্ত করলাম যুবকটির কাছে।আমার সব কিছু শোনার পর যুবকটি আমাকে সমবেদনা জানালো এবং আমাকে এখান থেকে মুক্ত করে আমার বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিলো।যুবকটির নাম রিয়াজ।রাজবাড়ী জেলার ছেলে।রিয়াজ ভোর বেলা আমার কাছ থেকে যাবার বেলায় বললো,'দুই দিন পর এসে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো,তৈরি থেকো' আর আমাকে কিছু কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিলো।

রিয়াজ চলে যাওয়ার পর মনে হলো,লোকটা ভালো মানুষ সাজার জন্য সুন্দর কিছু কথা বলে গেলো,আসলে সুন্দর কথায় মোহিতো হয়েইতো আজ জীবনের এই পরিণতি, তাই কোন সুন্দর কথাই এখন আর হৃদয়ে দাগ কাঁটেনা।

ঠিক দুই দিন পর রাত আটটার দিকে বিয়াজ আমার ঘরে হাজির।রিয়াজকে দেখে আমি আনন্দে আত্নহারা হয়ে ওকে জরিয়ে ধরেছিলাম।তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়েছিলো,আজকেই হয়তো আমার দুর্বিসহ জীবনের অবসান ঘটবে।ঠিক তাই,রিয়াজ আমাকে খুব দ্রুত তৈরী হয়েনিতে বলে,ওর নির্দেশনা অনুযায়ী এখান থেকে বের হওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে ফেলি।রাত ১টার দিকে ঘর থেকে বেরিয়ে পতিতা পল্লীর সমস্ত কালো দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে আমরা দৌলতদিয়া ঘাঁট এলাকায় পৌঁছাই।তারপর রিয়াজের রিজার্ভ করে রাখা মাইক্রোবাসে আমরা যশোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই।রাত চারটার দিকে আমাদের মাইক্রোবাস যশোর শহরে এসে পৌঁছায়।ড্রাইভারের ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে রাতের বাকিটুকু সময় আমরা একটা হোটেলে কাটাই।
হোটেলে একটু রেষ্ট নিয়ে ফ্রেস হয়ে দুপুরের দিকে আমি আর রিয়াজ আমাদের বাড়ীর দিকে রওয়ানা দেই।রওনা দেয়ার আগে রিয়াজকে বলি,রিয়াজ তুমি আমাদের বাড়ীতে আমার স্বামী হিসেবে পরিচয় দেবে এবং এখন থেকে আমাকে মহুয়ার পরিবর্তে লিপি নামে ডাকবে,বাকীটা আমি সামলাবো।রিয়াজ আমার কথা মত রাজি হয়।

বাড়ীতে পৌঁছে কলিংবলে টিপতেই মা গেট খুলে আমাকে দেখে জরিয়ে ধরে দীর্ঘক্ষণ কাঁদতে থাকে।মাকে বলি,মা ও তোমাদের জামাই, রিয়াজ।মা আমাকে এবং বিয়াজকে ঘরে তুলে নিয়ে যায়।মা তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেয়ে আমার প্রতি তার অভিযোগ,ক্ষোভের পরিবর্তে তার মধ্যে এক অনাবিল আনন্দধারা লক্ষ্য করলাম।মায়ের আনন্দ দেখে আমার বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছিলো।ভয় ছিলো বাবাকে নিয়ে।কিন্তু বিকেলে বাবা বাড়ী ফিরলে মা বাবাকে বুঝিয়ে সব কিছু স্বাভাবিক করে।রিয়াজকে বাবার সাথে পরিচয় করি দিলে বাবা রিয়াজকে স্বাভাবিক ভাবে জামাই হিসেবে গ্রহন করে।বাবার কোন বড় ছেলে না থাকায় রিয়াজকে পেয়ে বাবা এক দিক থেকে খুশীই হয়েছিলেন।তাই বাবার দুইটি ব্যবসার দায়িত্ব বাবা রিয়াজকে বুঝিয়ে দেন।রিয়াজ বাবার ব্যবসা ও অন্যান্য দায়িত্ব দক্ষতার সহিত পালন করায় কয়েক দিনের মধ্যে খুব বিশ্বস্ত হয়ে যায়।সেই সাথে রিয়াজের আচার আচরন পরিবারের সবার মধ্যে এক মুগ্ধতা এনে দেয়।মনে হচ্ছিলো আমাদের পরিবারটা যেন আবার সেই পুরোনো হাঁসি আনন্দে ভরে উঠেছে।যেন শুস্ক মরুতে বৃক্ষ উদ্যানে ছেয়ে যাওয়ার মত।

এক রাতে রিয়াজকে বলি,'রিয়াজ এভাবে মিথ্যে স্বামি স্ত্রী সেজে আর কত পাপ করবো,এসো আমরা গোপনে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলি'।রিয়াজ আমার প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে যায়।আমরা দুজন মিলে বিয়ের দিন ধার্য্য করি ২৫নভেম্বর।এর পর থেকে আমি ২৫ নভেম্বরের প্রতিক্ষায় প্রহর গুনতে থাকি আর রিয়াজকে প্রকৃত স্বামি হিসেবে পাবো এই ভেবে হৃদয়ে পুলক লাগছিলো।অন্য রকম এক অনুভূতিতে আমার সমস্ত দেহ মন ভেসে যাচ্ছিলো।জীবনের অন্ধকার স্মৃতিকে ঝেড়ে ফেলে নতুন জীবনের স্বপ্ন বীজ বুনতে শুরু করছিলাম।

২৪নভেম্বর রিয়াজ বাসা থেকে নাস্তা করে দোকানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।ঐ দিন দুপুরে খেতে বাড়ীতে আসেনা।ভেবেছিলাম দোকানে কাজের বেশী ব্যস্ততার কারনে আসতে পারে নাই,হয়তো বাইরে থেকে খেয়ে নিয়েছে।রাতে বাবা বাড়ী ফিরে এলে, বাবাকে রিয়াজের কথা জিজ্ঞেস করলে বাবা জানায় রিয়াজতো আজকে দোকানে বসেনি।এ কথা শোনার পর সারা রাত আমি না ঘুমিয়ে রিয়াজের প্রতিক্ষায় থাকি কিন্তু ঐ রাতে রিয়াজ আর বাসায় ফেরেনা।আমার প্রতিক্ষার কাংখিত ২৫তারিখ আসে, ২৬তারিখ চল যায়, এভাবে আরো দশ দিন অতিবাহিত হয় কিন্তু রিয়াজ আর আমার কাছে ফিরে আসেনা।

রিয়াজের জন্য আমি মানসিক ভাবে প্রচন্ড রকম ভেঙ্গে পড়েছিলাম।আমার এমন মানসিক অবস্থা দেখে বাবা আমার কাছে রিয়াজের যে ঠিকানা ছিলো ঐ ঠিকানা নিয়ে রিয়াজের খোঁজ করতে রাজবাড়ী যায়।কিন্তু বাবা রাজবাড়ী থেকে ফিরে এসে জানায় ঐ ঠিকানায় রিয়াজ নামে কেউ থাকেনা।খবরটা শুনে আমি নির্বাক নিথর হয়েগেলাম।রিয়াজের সান্নিধ্যে আমি ক্রমান্বয়ে আমার অভিশপ্ত অতীতকে ভুলে জীবনের স্বাভাবিক গতি ফিরে পাচ্ছিলাম,স্বপ্ন দেখছিলাম নতুন একটি সোনালী ভবিষ্যতের।বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও পদদলিত করে রিয়াজের অস্তিত্ব মিলিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।এখন আমার কোন বর্তমান নেই,ভবিষ্যৎ নেই..এই পৃথিবীর বুকে আমি যেন শুধুই এক দিক ভ্রান্ত...পথিক............................


বিঃদ্র যখন সাংবাদিকতার সাথে জরিতো ছিলাম তখন পেশাগত কারনে এই গল্পের রিয়াজ চরিত্রের সাথে আমার বাস্তবে আলাপ হয় এবং তার কাছ থেকে জানতে পারি এই গল্পের নায়িকা লিপির জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা।ঘটনাটা শুনে আমার মধ্যে চরম এক অনুতপ্ততা অনুভব করি লিপির জন্য।সেই অনুতপ্ততার জায়গা থেকে আমার অনুভূতিতে লিখে ফেলি অন্ধ গলির জীবন নামে লিপির আত্নকথন।লেখাটি প্রথম ছাপা হয় ০৯ ডিসেম্বর ২০০০ সালে দৈনিক গতকাল পত্রিকায়।লিপির জীবনের এই পরিণতির জন্য লিপির অন্ধ আবেগী ভালোবাসা দায়ী? পার্থ দায়ী? পিতা মাতার অবাধ ভালোবাসা? রিয়াজ?নাকি আমাদের ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থা,নাকি লিপির নিষ্ঠুর নিয়তি........?