রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৪

প্যারিসে খুঁজে ফেরা বাংলাদেশ

প্যারিসে এসেছি প্রায় তিন বছর আগে। আসার পর আড়াই বছর ছিলাম বাঙালি পরিমণ্ডলে। এখন ছিতে নটর ডেম-নিয়ন্ত্রিত একটি হোস্টেলে উঠেছি। বাঙালি পরিমণ্ডলে থাকার সময় কখনো বুঝতে পারিনি, আমি প্রবাসে আছি। বাংলাদেশি খাবার, বাংলা ভাষা, বাঙালির মমতা আমাকে ভুলিয়ে রেখেছিল প্রবাসের কষ্ট।
নতুন জায়গায় আমরা পাঁচজন মাত্র বাঙালি। বাকি সবাই ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের। আমার রুমমেট একজন আফ্রিকান। নাম ছেরগি। সাবেক ফ্রেঞ্চ কলোনির মানুষ হওয়ায় সুযোগ পেলেই মন খুলে ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে থাকে। ছেরগির কথা না বুঝলেও বোঝার ভান করে রুমে ওর সঙ্গে তাল মেলাতে হয়।
হোস্টেলের নিচতলার ক্যানটিন। খাওয়ার সময় আমরা বাঙালিরা এক টেবিলে বসার চেষ্টা করি। তখন আমাদের মধ্যে নিজ ভাষায় আলাপ হয়। খেতে খেতে আড্ডা দিই। আমাদের আড্ডায় যোগ দেয় একজন পাকিস্তানি। কিন্তু সে বাংলা বোঝে না। আড্ডায় নীরব থাকে। গায়ের রঙের কারণেই সে আমাদের টেবিলে বসে। তার সুবিধার্থে মাঝেমধ্যে আমরা ইংরেজি বলি।
ভাত-মাছে অভ্যস্ত আমাদের প্রথম প্রথম ফরাসি খাবারে সমস্যা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই আমরা মানিয়ে নিয়েছি। এখানে আমাদের অবসর সময়ের অনেকটাই কাটে বই পড়ে। মাঝেমধ্যে রাতের খাবার খেয়ে যাই প্যারিসের বুক চিরে বয়ে চলা সেন নদীর তীরে।

নদীর ওপর শিল্পের ছোঁয়া লাগানো কারুকার্যময় প্রশস্ত সেতু। এই সেতুর ওপর দাঁড়ালে অন্য রকম এক মুগ্ধতায় দেহ-মন ভরে যায়। সেতুর ওপর নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলোর আলোর দ্যুতি এবং মাঝেমধ্যে জোনাকির মতো মিটিমিটি আলো ছড়িয়ে প্রমোদতরির ভেসে চলার দৃশ্য এক ভিন্ন রকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। রাতের প্যারিসের এই সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ। রাতের এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দায়!
আমি যে এলাকার কথা বর্ণনা করছি, সে এলাকার নাম আনভালিদ।
এর পাশেই ভাস্কর্যসংবলিত চার স্তম্ভবিশিষ্ট দণ্ডায়মান সেতুটিকে মনে হয়, কাউকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করছে। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে চোখের দৃষ্টির দিক পরিবর্তন করলে দৃষ্টিতে ধরা দেবে সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত প্যারিসের সব স্থাপনার উচ্চতা ভেদ করে শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আইফেল টাওয়ার। সবুজ দূর্বা ঘাসে ঢাকা বিরাট মাঠ পেরিয়ে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সমাধি (আর্মি মিউজিয়াম) ও ফ্রান্সের ঐতিহাসিক পার্লামেন্ট ভবন।

আশপাশে একটু হাঁটলেই চোখে পড়ে
ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট দ্য গ্যলের ভাস্কর্য,
ঐতিহাসিক প্যালেস দ্য কনকর্ড, প্যারিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাভিনিউ দ্য সনজোলজি ছাড়াও অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা। মুগ্ধ হতে হয় বৃক্ষশোভিত নীরব ও মৃদু কোলাহলপূর্ণ প্রকৃতির আপন আতিথেয়তায়।
মাঝেমধ্যে আমি ছবি তোলার নেশায় ক্যামেরা হাতে সৌন্দর্য শিকারে ঘুরি-ফিরি বর্ণনাস্থলে। ক্যামেরায় প্যারিসের মনোলোভা সৌন্দর্যের ছবি তোলার সময় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। চোখে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের রাতের মায়াভরা রূপ ও চন্দ্রিমা উদ্যানের পড়ন্ত বিকেলের সৌন্দর্য। খুঁজে ফিরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার প্রিয় রাতের ফুলার রোডের সুখস্মৃতিমাখা দিনগুলো। যে সৌন্দর্যগুলো কখনোই ক্যামেরাবন্দী করা হয়নি আমার।
প্রবাসের চাকচিক্য রূপ-প্রকতির মধ্যেও বুকের এক কোণে আমার প্রিয় মাতৃভূমির একখণ্ড ছবি প্রতিনিয়ত বয়ে নিয়েই কাটে আমার প্রাত্যহিক দিনপঞ্জি। প্রতীক্ষার প্রহর গুনি, কবে ফিরে যাব আমার মাতৃভূমির বুকে। আবার নয়ন জুড়াব দেশমাতার রূপলাবণ্যে।


ফ্রান্সের বাংলা কমিউনিটির কিছু অসঙ্গতি এবং সাম্প্রতিক প্রেসক্লাব বিতর্ক।

প্রায় চল্লিশ হাজার জনগোষ্ঠীর আমাদের ফ্রান্সের বাংলাদেশী কমিউনিটি।প্রত্যেকেই কোননা কোন কারণে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে বসতি স্থাপন করেছি। আমরা যারা এই ভূখন্ডে বসবাস করছি তারা প্রত্যেকেই কোননা কোন ভাবে গুণান্বিত। কারো মধ্যে রয়েছে শিল্প সত্তা, কারো মধ্যে কঠোর পরিশ্রম ও জীবনের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার অদম্য মনোবল এবং সৃজনশীল মেধা ও মনন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে , আমাদের সহজাত গুন ও চিন্তাকে বিকশিত করার জন্য স্ব স্ব কর্মব্যস্ততার পাশাপাশী এখানে গড়ে তুলেছি নানাবিধ সাংস্কৃতিক,সামাজিক,রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন। দিন দিন কমিউনিটির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধন এবং উন্নত চিন্তা সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী তৈরির ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবনার সময়ও এসেছে।

আমার এখন পর্যন্ত এখানকার কোন সাংগঠনিক কর্মকান্ডে যুক্ত হবার সুযোগ হয়নি, কিন্তু চল্লিশ হাজার সদস্যের বাঙ্গালী পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে কিছু কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছি। এখানে কমিউনিটির বিভিন্ন ফেজবুক পেজের সাথে সংযোগ থাকার কারণে কমিউনিটির নানাবিধ খবর ফেজবুক ওয়ালে দেখতে পাই। কোন কোন খবর নিজেকে পুলকিত করে আবার কোন খবর সত্যি হতাশ করে। সম্প্রতি একটি কমিউনিটি পেজে ‘শতর্ক হউন’ ফ্রান্সে জামাতি প্রেসক্লাব শিরোনামের একটি লেখা কমিউনিটি সংক্রান্ত অনেক কথা মনের মধ্যে উস্কে দিলো। লেখাটিতে নির্দিষ্ট কয়েক জন ব্যক্তির এখানে আগমন,অবস্থান,বর্তমান সামাজিক অবস্থান,জ্ঞান গরিমা ইত্যাদি হেয় ভাবে বর্ণনা করে লেখক নিজের শ্রেষ্টত্বের প্রমান দেবার চেষ্টা করেছন ।আমরা যারা এখানে বসবাস করছি তারা সবাই জানি যে, কিছু ব্যক্তিবর্গ শিক্ষা বৃত্তি ,পড়াশুনা ও পেশাগতভাবে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ ছাড়া অন্য বৃহৎ অংশ কিভাবে বসবাসের স্থায়িত্ব লাভ করেছে। কোন যোগ্যতার বিশেষ মানদন্ডে আমরা এই স্থায়িত্ব লাভ করিনি, যেটা নিয়ে গর্ব করা যায়।ক্ষুদ্র স্বার্থে একজন বাঙ্গালী হয়ে এই দূরপ্রবাসে বসে অন্য বাঙ্গালীকে অসম্মান করার মধ্যে কোন গৌরব বা মহত্ব নিহিত থাকতে পারে কি? একজন বাঙ্গালী ভায়ের কাগজ হয়নি বলে এভাবে উলঙ্গ করার অধিকার কি আপনার আছে ? বরং আপনার কাগজ আছে বলে, কাগজ ছাড়া ভাইটির পাশে দাড়িয়ে,মানসিক ভাবে মনোবল জুগিয়ে তার কাগজ হওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করাই একজন গর্বিত বাঙ্গালীর  দায়িত্ব নয় কি ? শুধু এই বিষয়টিই নয় পূর্বেও এ ধরণের  আরো অনেক বিষয় দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধে নই। অনেক সময় জেনে,না জেনে আমরা ভুল করে থাকি।ধরুন আমি আপনার ভাই হয়ে একটা ভুল করেছি, তাই বলে আপনার একটা ফেজবুক এ্যাকান্ট বা নিউজ পোর্টাল আছে  বলেই আমাকে শুধরে না দিয়ে এবং সংশোধনের সুযোগ না দিয়ে এভাবে ন্যাংটা করে কমিউনিটির কাছে উপস্থাপন করবেন। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন, এটা কতটুকু ন্যায় সঙ্গত। কেউ যদি ভুল করে তা কমিউনিটির শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করাই সমীচীন নয় কি ? একবার ভাবুন, কাউকে নিয়ে নেতিবাচক কিছু লিখে ফেজবুকে পোষ্ট করে ছড়িয়ে দিলেন তা শুধু ফ্রান্সের কমিনিটির মানুষই দেখছেনা, মুহূর্তের মধ্যেই খবরটি পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে বসবাসরত বাঙ্গালীদের কাছে যা সত্যতা যাচাই ছাড়াই সবার মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সহ সমম্ত কমিউনিটি সম্পর্কে এক বিভ্রান্তিকর ধারণার জন্ম নিচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে যে বিষয়টি ফেজবুকে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে,তাহলো প্যারিসে একটি বাংলা প্রেসক্লাব গঠনকে কেন্দ্র করে। প্যারিসে গণমাধ্যম কর্মীদের একটি সংগঠন হবে এটি সত্যিই আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু এই ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ঘটনাগুলো অনেককেই মর্মাহত করেছে। আমার জানা মতে বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমগুলো তাদের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়োগকৃত প্রতিনিধিদের  কোন প্রকার ভাতা বা আর্থিক সুবিধা প্রদান করেনা। আর যারা করে তার পরিমান নিতান্তই নগন্য। সেই সূত্রে ফ্রান্সে বাংলাদেশী গণমাধ্যমের যেসব সংবাদকর্মী ভাইয়েরা কাজ করছেন তারা কোন প্রকার আর্থিক সুবিধা ছাড়াই ,নিজ খরচে ক্যামেরা কিনে স্বেচ্ছায় সামাজিক  দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কমিনিটিকে সেবা দিয়ে চলছেন। এ জন্য আপনাদের সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হচ্ছে, আপনারা কমিউনিটির মহৎ,সচেতন ও সেরা মানুষদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ নিজস্ব কর্মব্যস্ততার পাশাপাশী  আপনারা এখানকার  বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের নিয়ে ভাবেন এবং তাদের সুখ দুঃখ,আনন্দ বেদনা,আচার অনুষ্ঠান মিডিয়ার মাধ্যমে ষোল কোটি বাঙ্গালীর কাছে তুলে ধরেন। বিনিময়ে কমিউনিটির মানুষ আপনাদেরকে সমীহ করে,সম্মান করে,শ্রদ্ধা করে। তাই আমি বলবো, আপনারা শুধু একটি প্রেস ক্লাব নয়,একটি মহতি সংঘ গঠনের উদ্যেগ নিয়েছিলেন।যেহেতু সমাজের মহৎ ও সচেতনদের সংগঠন তাই প্রাথমিক পর্যায়ে দ্বন্দের ঊর্ধে থাকাই বাঞ্চনীয় ছিলো। দেখতে পেলাম একটি কমিটি না হয়ে দুইটি কমিটি আত্নপ্রকাশ করেছে। কারণ নেতৃত্বের ভাগাভাগিতে সমঝোতায় না পৌঁছানো। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ফেজবুকের পাতায় উলঙ্গ করার যে মহড়া দিচ্ছে তা খুবই হতাশা ব্যঞ্জক। আপনারা কমিউনিটির সেরা অংশ হয়ে যদি একে অপরকে ছোট করে উপস্থাপন করেন,অসম্মান করেন, তাহলে অন্যরা কি করবে ? সুষ্ঠ, সঠিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হলে একদিন সবাই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাদ নিতে পারবেন। কেউ একটু আগে পরে হলে কি এমন ক্ষতিইবা হবে। এমন একটি ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ একেবারেই অগ্রনযোগ্য।
যে দিন দেখবো বাংলাদেশী যুবকেরা ক্যামেরা হাতে ফরাসি সংবাদের পিছে ছুটছে,ফরাসি মিডিয়ায় পেশাদারী ভাবে কাজ করছে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় বাংলা ভাষাভাষী সাংবাদিকদের একটি সংগঠন বা প্রেসক্লাব নির্মিত হয়েছে, সেই দিন মনে হবে ফরাসী বাংলা কমিউনিটির কিছু অর্জন হয়েছে। আজ কমিউনিটি প্রেসক্লাব গঠনের যে ক্ষুদ্র প্রয়াস চলছে আশা করি এখান থেকেই আপনারা সমস্ত দ্বন্দের ঊর্ধে গিয়ে এবং একত্রিত হয়ে সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে বাংলা কমিউনিটির মানুষদের এগিয়ে নিতে কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করে যাবেন।
পরিশেষে বলতে চাই,আমরা বাংলাদেশ থেকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চক্রান্তের যে বিভাজন প্রক্রিয়ার মন্ত্র মস্তিস্কে  ধারণ করে এখানে এসেছি তা ঝেড়ে ফেলে, এই ভূখন্ডের জাতিগোষ্ঠীর (ফরাসি) জাতীয়তাবোধ,রাষ্ট্রের প্রতি মমত্ব ও ঐক্য থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রিয় স্বাধীন সার্বভৌম মাতৃভূমিটাকে ভালোবাসি এবং প্রবাস থেকে  দেশপ্রেম ও ঐক্যের মডেল হয়ে দেশের মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করি। আমরা শোষকের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মু্ক্ত হয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পেলেও এখনো অর্থনীতির পরাধীনতার জালে আবদ্ধ তাই আমাদের একমাত্র অর্থনৈতিক মুক্তির যে যুদ্ধ চলছে ,সেই যুদ্ধে প্রত্যেক প্রবাসী যার যার নিজস্ব অবস্থান থেকে অবদান রাখবো, এটাই প্রত্যাশা।